মার্কেটিং এর মৌলিক ধারণা

মার্কেটিং এর মৌলিক ধারণা

মার্কেটিং করতে হলে অবশ্যই এর মৌলিক ধারণা থাকতে হবে। ক্রেতাদের প্রয়োজন, অভাব, চাহিদা, পণ্য, সেবা, অভিজ্ঞতা, ভ্যালু, সন্তুষ্টি, বিনিময়, লেনদেন, সম্পর্ক ও বাজার ইত্যাদি অন্তর্নিহিত উপাদানকে মার্কেটিং বা বাজারজাতকরণের মৌলিক ধারণা বলে। মৌলিক ধারণা জানার আগে মার্কেটিং সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

মার্কেটিং কাকে বলে

মার্কেটিং শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘marketus’ হতে ‘market’ এবং এর থেকে marketing শব্দের উৎপত্তি। Marketing এর বাংলা পারিভাষিক শব্দ হলো বাজারজাতকরণ। মার্কেটিং এর জনক ফিলিপ কটলার(Philip Kotler) এর মতে, “বাজারজাতকরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোম্পানিগুলো ক্রেতাদের জন্য ভ্যালু সৃষ্টি করে এবং বিনিময়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে ভ্যালু অর্জনের লক্ষ্যে শক্তিশালী ক্রেতা সম্পর্ক গড়ে তুলে।” American Marketing Association এর মতে, “বিনিময়ের মাধ্যমে ব্যাক্তির সন্তুষ্টি বিধান এবং প্রতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্যাবলি অর্জনের জন্য ধারণা, পণ্য ও সেবার পরিকল্পনা প্রণয়ণ ও বাস্তবায়ন, মূল্য নির্ধারণ প্রসার ও বণ্টন প্রক্রিয়াকে বাজারজাতকরণ বলা হয়।” এবার জেনে নেওয়া যাক মার্কেটিং এর মৌলিক ধারণাগুলো সম্পর্কে

১. প্রয়োজন, অভাব ও চাহিদা

একজন মার্কেটারকে জানতে হবে প্রয়োজন, অভাব ও চাহিদা কি?

ক. প্রয়োজন(Needs): মানুষ যখন নিজেকে কোন কিছু থেকে বঞ্চিত করে তাই তার প্রয়োজন। যেমন – খুদা লাগলে মানুষ খাওয়ার কথা চিন্তা করে। প্রয়োজন অনেক প্রকার হয়ে থাকে যথাঃ-

  • শারীরিক (খাদ্য, বস্ত্র,বাসস্থান, চিকিৎসা,নিরাপত্তা)
  • মানসিক (বিনোদন, ভ্রমণ, সুস্থতা)
  • ব্যক্তিগত (সাফল্য, পুরস্কার, অর্জন, ক্ষমতা)
  • সামাজিক (ভালোবাসা, সামাজিক অবস্থান, বন্ধুত্ব )

প্রয়োজন মানুষের মনের সুপ্ত অবস্থা। মার্কেটিং কারার সময় মানুষের প্রয়োজন কি তা খুঁজে বের করতে পারলে ব্যবসায় সফলতা দ্রুত আসবে।

খ. অভাব (Wants): প্রয়োজন যখন ব্যক্তিত্ব ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রকাশিত হয়ে উঠে তখন তাকে অভাব বলে। যেমন- খুদা লাগলে আমরা ভাতের অভাব বোধ করি। আবার আমেরিকানরা ফাস্ট ফুডের অভাব বোধ করে। অভাব ব্যক্তির আচরণ, সংস্কৃতি, ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান ও আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল।

অভাব মানুষের প্রকাশিত অবস্থা। মানুষের অভাবের প্রতি লক্ষ্য রেখে পণ্য বা সেবা মার্কেটিং করতে হবে। একজন মার্কেটারকে মানুষের অভাবগুলো চিহ্নিত করতে হবে।

গ. চাহিদা(Demands): কোন কিছুর অভাব, অভাব পূরণের সামর্থ্য এবং অর্থ ব্যয় করে অভাব পূরণের ইচ্ছা থাকলে তাকে চাহিদা বলে। ধনী কৃপনের গাড়ি ক্রয়ের ইচ্ছা আবার গরিবের গাড়ি ক্রয়ের ইচ্ছা কোনটিই চাহিদা হবে না। কারণ কৃপণ অর্থ ব্যয় করতে চায় না। আর গরিবের অর্থ ব্যায়ের সামর্থ্য নেই।

মার্কেটিং এর মূল কাজ চাহিদা সৃষ্টি করা। বিজ্ঞাপনগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যাতে পণ্য বা সেবার চাহিদা সৃষ্টি হয়। চাহিদা তৈরি করতে পারলেই পণ্য বিক্রির সম্ভাবনা বাড়বে।

২.বাজার অর্পণ- পন্য, সেবা ও অভিজ্ঞতা

Market offering খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পণ্য, সেবা ও অভিজ্ঞতাকে মার্কেট অফারিং বলে। মার্কেটারকে এগুলো সম্পর্কে ক্লিয়ার কনসেপ্ট থাকতে হবে।

ক. পন্য (Products): মানুষের প্রয়োজন ও অভাব পূরণ করতে পারে এমন যা কিছু বাজারে উপস্থাপন করা হয় তাকে পণ্য বলে। পন্য বস্তুগত( বই, খাতা, কলম, গাড়ি, কম্পিউটার ইত্যাদি) হয় আবার স্থান, ধারণা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদিও পণ্য হতে পারে।

মার্কেটিং শুধু অভাব পূরণ করতে পারে এমন পণ্য বাজারে আনেনা বরং ভোক্তাকে সন্তুষ্টি করতে পারে এমন পণ্য উপস্থাপন করে।

খ. সেবা(Services ): সেবা হচ্ছে এমন কোন কাজ বা সুবিধা যা এক পক্ষ অন্য পক্ষকে প্রদান করে, যা অদৃশ্য এবং যার মালিকানায় পরিবর্তন ঘটে না। যেমন – সেলুনে চুল কাটা, বিউটি পার্লারে রূপ চর্চা, ডাক্তারের চিকিৎসা, শিক্ষকের পাঠ দান, যানবাহনে চড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদি হলো সেবার উদাহরণ।

Service Marketing ভালো করতে হবে। মানুষ এখন যেখানে ভালো সেবা পাওয়া যায় সেখান থেকে সেবা গ্রহণ করে।

গ. অভিজ্ঞতা (Experience): কোন বিষয় সম্পর্কে অর্জিত বাস্তব জ্ঞানকে অভিজ্ঞতা বলে।এটি কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি নিজেকে বা প্রতিষ্ঠানকে তুলে ধরতে পারে। অভিজ্ঞতা ব্যক্তির নিজেস্ব সম্পদ।

বর্তমানে মার্কেটিং করার জন্য অভিজ্ঞতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য অভিজ্ঞ লোকের চাহিদা বেশি। অভিজ্ঞতা থাকলে মার্কেটিং এ সফলতা অবশ্যই আসবে।

৩. ক্রেতা ভ্যালু ও সন্তুষ্টি

মার্কেটিং এ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ক্রেতার জন্য ভ্যালু সৃষ্টি ও তাকে সন্তুষ্টি প্রদান করা। এজন্য পণ্য বা সেবা ক্রেতার প্রত্যাশিত হতে হবে। উপযুক্ত মূল্যে, সর্বোচ্চ মানের পণ্য এবং সর্বোচ্চ মানের সেবা প্রদান করার মাধ্যমেই ক্রেতা ভ্যালু ও সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব হবে।

ক. ক্রেতা ভ্যালু(Customer value): পণ্য বা সেবা থেকে ক্রেতা যে সুবিধা পায় এবং এর বিনিময়ে ক্রেতা যে মূল্য পরিশোধ করে এই দুইয়ের পার্থক্যকে ক্রেতা ভ্যালু বলে। যেমনঃ একজন লোক ৫০ টাকা দিয়ে একটি সাবান কিনলেন। এখানে, সাবানের গুণগতমান, সুগন্ধ, কার্যকারিতা ইত্যাদি সুবিধা যদি সাবানের মূল্যে থেকে বেশি হয় তবে ক্রেতা ভ্যালু বৃদ্ধি পাবে আর কম হলে ক্রেতা ভ্যালু হ্রাস পাবে।

মার্কেটিং এর অন্যতম প্রধান কাজ ক্রেতা ভ্যালু সৃষ্টি করা। এজন্য ক্রেতার প্রত্যাশিত পণ্য বা সেবা সরবরাহ করতে হবে। যে প্রতিষ্ঠান যত বেশি ক্রেতা ভ্যালু প্রদান করতে পারবে সেই প্রতিষ্ঠান তত বেশি সফলতা পাবে এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে।

খ. ক্রেতা সন্তুষ্টি (Customer satisfaction): কোন পণ্য বা সেবা যদি ক্রেতার প্রত্যাশার সাথে মিলে যায় তাহলে ক্রেতা সন্তুষ্ট হয়। অর্থাৎ পণ্য বা সেবা গ্রহণের পর ক্রেতার মনে যে আনন্দ বা হতাশার সৃষ্টি হয় তাকে ক্রেতা সন্তুষ্টি বলে। প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তি মিলে গেলে কাস্টমার সন্তুষ্ট হয় আর প্রাপ্তি কম হলে কাস্টমার অসন্তুষ্ট হয়। যেমনঃ ক্রেতা সাবানটি ব্যবহার করে যদি খুশি হয় তা হলো সন্তুষ্টি।

মার্কেটিং এ ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলেই বাজার নেতা হওয়া যায়। কেননা কাস্টমার যে পণ্য বা সেবার উপর সন্তুষ্ট থাকে সেইটাই গ্রহণ করে। ক্রেতা সন্তুষ্টির মাধ্যমে সারা জীবন ক্রেতার কাছ থেকে মুনাফা অর্জন করা যায়।

৪. বিনিময়, লেনদেন ও সম্পর্ক

বিনিময় প্রথা বলতে কোন কিছু পাওয়ার বিনিময়ে কাউকে কিছু প্রদান করাকে বুঝায়। বহুকাল আগে বিনিময় প্রথা চালু হয়েছে। আধুনিক যুগে এর ব্যবহার কমে গেলেও হারিয়ে যায়নি। দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে আর্থিক মূল্য দ্বারা কোন পণ্য বা সেবা বিনিময় হলে তাকে লেনদেন বলা হয়। সম্পর্ক বলতে পণ্য বা সেবা মার্কেটিং এর সাথে জড়িত বিভিন্ন পক্ষের সাথে দীর্ঘমেয়াদি সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য যাবতীয় কার্যাবলি।

মার্কেটারকে Exchange, Transaction, Relationships Marketing সম্পর্কে ধারণা রাখতে হয়। কিভাবে এই ধারণাগুলো উন্নত করে কাজে লাগানো যায় তা চিন্তা করতে হবে। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমেও বর্তমানে মার্কেটিং এর এই বিষয়গুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।

৫. বাজার (Market)

মার্কেটিং এ বাজার বলতে স্থানকে বুঝায় না। এখানে বাজার বলতে ক্রেতাকে বুঝায়। এই ক্রেতা দুই ধরনের হতে পারে বর্তমান ও সম্ভাব্য ক্রেতা। বাজারজাতকরণের দৃষ্টিতে বাজার হচ্ছে কোন পণ্য বা সেবার বর্তমান ও সম্ভাব্য ক্রেতার সমষ্টি। তার মানে যারা পণ্য বা সেবা এখন গ্রহণ করছে এমন ক্রেতা(actual buyers) এবং যারা ভবিষ্যতে গ্রহণ করতে পারে সেসব ক্রেতাদের(potential buyers) সমষ্টিকে বাজার বলে।

মার্কেটারকে সবসময় বাজার সৃষ্টি করতে হয়। এজন্য বর্তমান ক্রেতাদের ধরে রাখা এবং সম্ভাব্য ক্রেতা খুঁজে বের করে তাদের পণ্য বা সেবা গ্রহণের জন্য প্ররোচিত করা হয়।

মার্কেটিং ভালোভাবে বুঝতে হলে এই মৌলিক ধারণা গুলো জানতে হবে। এগুলো নিয়ে গবেষণা করতে হবে ক্রেতাদের প্রয়োজন কি, তারা কিসের অভাব অনুভব করছে, কিভাবে পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করা যায়, পণ্য কেমন হওয়া উচিত, কিভাবে উত্তম সেবা দেওয়া যায়, অভিজ্ঞতাকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়, কিভাবে ক্রেতা ভ্যালু প্রদান ও সন্তুষ্টি করা যায়, ক্রেতার সাথে দীর্ঘমেয়াদি সুসম্পর্ক স্থাপনের উপায় কি, কিভাবে পণ্য বা সেবার বাজার বৃদ্ধি করা যায়। প্রতিযোগিতা টিকে থাকতে হলে মার্কেটিং এর প্রতিটি বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করে কাজ করতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *