হার্ট বা হৃদপিন্ড, মানবদেহের একটি পেশীবহুল অঙ্গ যেটি মানুষের বুকের ঠিক মাঝ বরাবর দুই ফুসফুসের মাঝখানে অবস্থান করে। আমরা জানি হৃদপিন্ড আমাদের সারা শরীরে রক্ত সরবরাহের কাজ করে থাকে। মিনিটে প্রায় ৭২ বার করে স্পন্দিত হওয়ার মাধ্যমে এটি আমাদের দেহের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত পৌঁছে দেয়। ফলে আমাদের দেহকোষগুলো সজীব থাকে এবং আমাদের অঙ্গসমূহ সচল থাকে।
তো, যে অঙ্গটির রক্ত সংবহন প্রক্রিয়ার ফলে আমাদের দেহযন্ত্র সচল থাকছে সেটির নিজের পুষ্টির উৎস কি? হার্ট বা হৃদপিন্ডের গায়ে করোনারি আর্টারি নামে ছোট দুটি ধমনী থাকে যেগুলো হার্টে পুষ্টির যোগান দিয়ে থাকে। এই ধমনীগুলো হার্টে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত পৌঁছে দেয়। কিন্তু যখন কোন কারণে এ ধমনীতে ব্লকের সৃষ্টি হয়, হতে পারে সেটি কোলেস্টেরল বা চর্বি জমে বা অন্য যে কোন কারণে, তখন হার্টের যে এলাকা ঐ ধমনীবাহিত রক্তের পুষ্টি নিয়ে চলে সে জায়গার পেশী অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে হার্টে রক্তের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং মানুষ হার্ট এটাকে আক্রান্ত হয়। বইয়ের ভাষায় হার্ট এটাককে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (Mayocardial Infarction) নামেও অভিহিত করা হয়।
হার্ট এ্যাটাকের কারণ
হার্ট এটাক মূলত হয় তখন, যখন একটি বা দুটি করোনারী আর্টারীর দেয়ালে কোথাও ব্লকের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন কারণে আর্টারীতে ব্লকের সৃষ্টি হতে পারে। কোলেস্টেরল বা চর্বিজাতীয় কোন বস্তু জমে জমে ধমনীর রক্ত চলাচলের পথ সরু হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের অবস্থাগুলোকে করোনারী আর্টারী ডিজিজ বলা হয়ে থাকে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের রোগের কারণেই হার্ট এটাক হয়ে থাকে।
অনেকক্ষেত্রে হার্ট এটাকের সময় ধমনীর দেয়ালে জমাটবাঁধা এ ধরনের বস্তুগুলো ফেটে পড়ে রক্তপ্রবাহের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর রক্তপ্রবাহের মধ্যেই আবার জমাট বাঁধতে শুরু করে এবং ছোট-বড় দলা পাকাতে থাকে। যদি এই জমাট বস্তুর দলা বেশি বড় হয় তখনও রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয় বা বন্ধ হয়ে পড়ে। ফলে হৃদপেশীর কোষগুলো অক্সিজেন ও পুষ্টির অভাবে অচল হতে শুরু করে। এজন্য অনেক সময় দেখা যায় হার্টের সমস্যায় চিকিৎসা করানোর পরেও আবার হার্ট এটাক হতে পারে। বিভিন্ন পর্যায়ের হার্টের রোগের চিকিৎসা ভিন্ন ভিন্ন হয়। কারও হয়তো পুরোপুরি ব্লক থাকে, কারো আংশিক থাকে এবং কারও একবার চিকিৎসার পরেও আবার সমস্যা দেখা দিতে পারে। রোগের অবস্থার উপর নির্ভর করে চিকিৎসাও বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। হার্ট এটাকের আরেকটি কারণ হলো করোনারী আর্টারী স্পাজম বা যাকে করোনারী ধমনীর খিঁচুনী বলা যেতে পারে। বিভিন্ন ধরনের ড্রাগস যেমন তামাক, কোকেইন ইত্যাদি গ্রহনের কারণে এ ধরনের স্পাজম হতে পারে।
এছাড়াও হার্ট এটাকের জন্য দায়ী কিছু অনিয়ন্ত্রণযোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টর আছে যেগুলো হলোঃ
- বয়সঃ এটি হার্ট এটকের ক্ষেত্রে একটি অনিয়ন্ত্রণযোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টর। ৪৫ বছরের উর্ধ্বে পুরুষ ও ৫৫ বছরের উর্ধ্বে নারীরা যুবক-যুবতীদের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
- লিঙ্গঃ পুরুষেরা নারীদের চেয়ে বেশী হার্ট এটাকের ঝুঁকিতে থাকেন।
- বংশগতঃ যাদের বংশগতভাবে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগের ইতিহাস আছে তারাও হার্ট এটাকের ঝুঁকিতে থাকেন।
- ধূমপান বা মাদকাসক্তিঃ যারা ধুমপান বা মাদকে আসক্ত তারাও এর ঝুঁকিতে থাকেন।
- উচ্চ রক্তচাপ বা উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরলঃ দীর্ঘদিন যাবৎ উচ্চ রক্তচাপে ভুগলে বা রক্তে এল ডি এল (LDL) জাতীয় কোলেস্টেরলের মাত্রাবেশি থাকলে হার্ট এটাকের ঝুঁকি থাকে।
- কায়িক পরিশ্রমের ঘাটতিঃ কায়িক পরিশ্রমহীনতার কারণে আজকাল অনেকে মুটিয়ে যাওয়া, বিপাকীয় বিভিন্ন সমস্যায় ভুগে থাকেন। এর ফলে তারা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরলের সমস্যাসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হন যেগুলো হার্ট এটাকে আক্রান্ত হওয়ার জন্য দায়ী।
- মানসিক চাপঃ মানসিক চাপও হার্ট এটাকে আক্রান্ত হওয়ার নিয়ন্ত্রণযোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোর একটি।
এছাড়া অধিক পরিমাণে চর্বি জাতীয় খাদ্যগ্রহণ, আঁশজাতীয় খাবার কম খাওয়া, অটোইমিউন কন্ডিশন, প্রিএকলাম্পসিয়ার প্রবণতা, হাইপার ইস্ট্রোজেনোমিয়া, জন্মনিয়ন্ত্রক পিল সেবন ইত্যাদিও হার্ট এটাকের রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে।
হার্ট এ্যাটাকের লক্ষণ
হার্ট এটাকের লক্ষণগুলো সকলের ক্ষেত্রে একই হবে তা কিন্তু নয়। একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকমের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। কারও ক্ষেত্রে হালকা ব্যাথা থাকে আবার কারও ব্যাথার পরিমাণ অনেক বেশি হয়। কারও হয়তো কোন লক্ষণই প্রকাশ পেলোনা, হঠাৎই কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট হয়ে বসে। তবে হঠাৎ আক্রান্ত হওয়া রোগীর চাইতে কয়েক ঘন্টা, কয়েক দিন এমনকি কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া রোগীর সংখ্যাই বেশি। অনেকেই অসাবধানতাবশতঃ বা অবহেলা করে প্রকাশিত লক্ষণগুলোকে গুরুত্ব দেন না বলে অনেক সময়ই মারাত্মক দূর্ঘটনা ঘটে বসে।
হার্ট এটাকের সাধারণ লক্ষণগুলো হলোঃ
- বুকে হঠাৎ চাপ, অস্বস্তি, ব্যাথা, মোচড়ানো বা ব্যাথার অনুভূতি বোধ করা যেটি ধীরে ধীরে বেড়ে বাহু, ঘাড়, পিঠ, চোয়ালের দিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- বমি বমি ভাব, বদহজম, বুকজ্বলা বা পেটব্যাথাও হতে পারে।
- হঠাৎ শ্বাসকষ্টও দেখা দিতে পারে।
- ক্লান্তি বা অবসন্নতা বোধ হতে পারে।
- অনেক সময় শীতল ঘাম হয়।
- মাথা ঝিম ঝিম করতে পারে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে পারে।
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, ইত্যাদি লক্ষণগুলো প্রাথমিকভাবে দেখা দিতে পারে।
হার্ট এ্যাটাক হলে তাৎক্ষনিক করণীয়
হঠাৎ করে যদি কেউ হার্ট এটাকে আক্রান্ত হন তাহলে প্রাথমিকভাবে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় সে ব্যাপারে কিছুটা ধারণা থাকা দরকার। তাহলে জরুরী মুহূর্তে রোগী হয় নিজেকে কিছুটা সাহায্য করতে পারবেন বা সাথে যারা থাকেন তারা হাসপাতালে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত রোগীকে যথাসম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারবেন। জরুরী মুহূর্তে বিচলিত না হয়ে নিচের কাজগুলো করা যেতে পারে।
- সর্বপ্রথম কথা হলো হার্ট এটাক হলে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতে হবে।
- রোগী যদি একা থাকেন তাহলে যে কোনভাবে হোক অন্য কাউকে জানানোর চেষ্টা করতে হবে। এর মাঝে নিজেকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করে যেতে হবে। যেমন-
১। আক্রান্ত ব্যক্তি জোরে উচ্চস্বরে বার বার কাশি দিতে থাকবেন। এতে করে হার্টের সংকোচন-প্রসারণ প্রক্রিয়া বজায় থাকবে এবং হার্টের মধ্য দিয়ে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। প্রতিবার কাশির আগে যতটা সম্ভব লম্বা করে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। এভাবে প্রতি দুই সেকেন্ড অন্তর শ্বাস-কাশি প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রাখার চেষ্টা করতে হবে যতক্ষণ না অন্য কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে আসছেন। অনেক সময় এ প্রক্রিয়ার ফলে হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক হয়ে আসে। ফলে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে কিছুটা ঝুঁকিমুক্ত হওয়া যায়।
২। একান্ত নিরুপায় না হলে আক্রান্ত ব্যক্তি পায়ে হেঁটে বা নিজে গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দেয়াটা ঠিক হবে না। এতে যে কোন মারাত্মক দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
৩। যদি আপনার সামনে অন্য কেউ হার্ট এটাকে আক্রান্ত হন তাহলে প্রথমেই তকে সটান করে শুইয়ে দিন। আঁটসাঁট জামাকাপড় পরে থাকলে তা ঢিলা করে দিন। এ সময় কোন ধরনের খাবার, ঠান্ডা বা মিষ্টি পানীয় তার মুখে দেয়া যাবে না। তবে রোগী যদি অতিরিক্ত পরিমাণে ঘামতে থাকে তবে জিহবার নিচে এক চামচ গ্লুকোজ দেয়া যেতে পারে।
৪। রোগী যদি অচেতন হয়ে যান তাহলে তাকে শুইয়ে বারংবার বুকে হালকা চাপ দিতে হবে যাতে হার্টে পাম্প হয়। এরপর রোগীর মুখে মুখ লাগিয়ে ফুঁ দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫। হঠাৎ হার্ট এটাকে আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার পথে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে অনেকে এসপিরিন বা ওয়ারফেরিন জাতীয় ঔষধ খাওয়ানোর কথা বলেন। তবে এক্ষেত্রে ডাক্তারের রিকমেন্ডেশন থাকলে ভালো হয়। ডাক্তার যদি এ রোগীর ক্ষেত্রে এ জাতীয় ঔষধ বা নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে প্রেসক্রাইব করে থাকেন তাহলেই এগুলো বেশি নিরাপদ।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এ সময়ের জন্য যা হওয়া উচিত সেটি হলো যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হৃদরোগের চিকিৎসাসুবিধা সংবলিত যে কোন কাছের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে জরুরী চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি প্রতি মুহূর্তে রোগীকে আশ্বস্ত রাখা।
হার্ট এ্যাটাক প্রতিরোধের উপায়
আমরা জেনেছি হার্ট এটাকের ক্ষেত্রে কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর আছে যেগুলো নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। কিন্তু যে রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো নিয়ন্ত্রণযোগ্য, সেগুলোর বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকা উচিত। যেমন-
১। ধূমপান বা যে কোন ধরনের মাদক সেবনের অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করার চেষ্টা করা।
২। স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের প্রতি মনোযোগী হওয়া।
৩। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের চেষ্টা করা।
৪। নিয়মিত পরিমিত পরিমাণে কায়িক শ্রমের মধ্যে থাকা।
৫। কারও যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে নিয়মিত ব্লাড শ্যুগার পরীক্ষা করা এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ গ্রহণ করা।
৬। কারও যদি সন্দেহ হয় যে তার হার্টে কোন ধরনের সমস্যার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাহলে বিলম্ব না করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
অনেক সময়ই দেখা যায় হার্ট এটাক হলে করণীয় বিষয়ে সাধারণ কিছু প্রাথমিক জ্ঞান না থাকায় আমরা রোগীকে সময়মত উপযুক্ত সাহায্য করতে পারিনা। অথচ এগুলো জানা থাকলে ও সময়মত প্রয়োগ করতে পারলে হতে পারে কোন বড় দূর্ঘটনা এড়ানো যেতে পারে।
তাই এ রোগের কারণ, লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয় বিষয়ে আজকের আলোচনা থেকে পাঠকেরা প্রাথমিক জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সময়ে বিচক্ষণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন বলে আশা করছি।