আজকাল প্রায়শই খুব অল্প বয়স্ক মানুষজনের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এবং দিন দিন এ সংখ্যা যেনো উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে। বর্তমান বিশ্বে ব্রেইন স্ট্রোককে মানুষের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
কিন্তু সবচেয়ে চিন্তার বিষয় যেটি, তা হচ্ছে সাধারণ পর্যায়ে বেশিরভাগ মানুষই ব্রেইন স্ট্রোককে হার্ট এ্যাটাকের সাথে গুলিয়ে ফেলছেন। হার্ট এ্যাটাক হলে বলছেন স্ট্রোক করেছে, আবার কখনও স্ট্রোক হলেও বলছেন হার্ট এ্যাটাক হয়েছে। অথচ এ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। দুটির লক্ষণও ভিন্ন। আবার আমরা স্ট্রোকের বিভিন্ন লক্ষণগুলোকেও একেক সময় একেক রোগের সাথে মিলিয়ে ফেলি। ফলে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসাও নেয়া হয়না।
তাই আমাদের সকলেরই এ রোগটি সম্পর্কে এবং এর লক্ষণগুলো সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক এবং পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। আজ এ বিষয়েই কিছু আলোচনা করবো।
ব্রেইন স্ট্রোক কি এবং কেন হয়?
আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের প্রধান অংশ হলো মস্তিষ্ক। আবার মস্তিষ্কই আমাদের পুরো দেহের চালিকাশক্তি। আর মস্তিষ্ককে সচল রাখার জন্য রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন ও গ্লুকোজ সঠিকভাবে মস্তিষ্কের কোষকলায় পৌঁছানো আবশ্যক। কিন্তু যদি কোন কারণে মস্তিষ্কের কোন অংশে রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে তাহলে মস্তিষ্কের কোষকলার মৃত্যু ঘটে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মস্তিষ্কের ঐ অংশের কোষকলা শরীরের যেসব অঙ্গের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতো সেসব অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে এই যে শারীরবৃত্তীয় কাজে দ্রুত অব্যবস্থাপনা দেখা দেয়, একেই মূলত স্ট্রোক বলা হয়।
স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পিছনে নানাবিধ কারণ কাজ করে। সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করতে গেলে কারণগুলোকে নিম্নরূপে সাজানো যায়।
- উচ্চ রক্তচাপ
- উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল
- ডায়াবেটিস
- হৃদরোগ
- হরমোনজনিত সমস্যা
- গর্ভাবস্থা
- ক্যানসার
- নির্দিষ্ট কোন রক্তজনিত রোগ (যেমন- হৃদরোগীদের রক্ত পাতলা থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের ঔষধ প্রয়োগ করা হয়। অতিরিক্তমাত্রায় এ ধরনের ঔষধ গ্রহণ করলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকে।)
- মস্তিষ্কের কোন শিরার পাতলা দেয়াল বা রক্তনালীর গঠন বিকৃতি
- স্থূলতা
- শারীরিক পরিশ্রমহীনতা
- ধূমপান বা মাদক সেবন
- বংশগত ইতিহাস
- বয়স ইত্যাদি।
ব্রেইন স্ট্রোকের প্রধান লক্ষণসমূহ
ব্রেইনের কোন অংশের কোষকলা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তার উপর নির্ভর করে, স্ট্রোকের লক্ষণ কেমন হতে পারে। যদি দেহের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম (যেমন- নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন ইত্যাদি) পরিচালনা করে ব্রেইনের এমন অংশে ব্লকেজের কারণে স্ট্রোক হয়, তাহলে এটি খুবই ভয়াবহ অবস্থা। এক্ষেত্রে রোগীর জীবন হুমকির মুখে থাকে।
কিন্তু যদি মস্তিষ্কের এমন এলাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয় যেটি দেহের বিভিন্ন অঙ্গের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে কিছু উপসর্গ পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে রোগী যে ধরনের স্ট্রোকেই আক্রান্ত হন না কেন, হোক তা “ইস্কেমিক স্ট্রোক (আঞ্চলিকভাবে রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়া)” বা “হেমোরেজিক স্ট্রোক (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ)”, দু অবস্থাতেই কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখা যায়। যেমন-
- রোগীর মুখের যে কোন এক পাশের মাংসপেশী অসাড় হয়ে পড়তে পারে বা ঝুলে পড়তে পারে। এ সময় রোগী হাসতে পারেন না, কথা বলতে পারেন না, কথা জড়িয়ে যায়, শব্দচয়নে সমস্যা হয়।
- রোগী তার হাত-পা বা দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাড়াতে অক্ষম হয়ে পড়েন। এ সময় রোগীকে তার দু’হাত সোজা উপরে উঠাতে বললে বা উঠে দাঁড়াতে বললে তিনি তা পারবেন না।
এ ধরনের অবস্থা কারও দেখলে বুঝতে হবে তিনি স্ট্রোক করতে যাচ্ছেন বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। এ অবস্থায় কেউ পতিত হলে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
- স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী অনেক সময়ই তীব্র মাথাব্যাথার স্বীকার হন। তীব্র মাথাব্যাথা বিভিন্ন কারণেই হতে পারে। কিন্তু যদি হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই প্রচন্ড মাথাব্যাথা হয় তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। কারণ এটি স্ট্রোকের লক্ষণও হতে পারে।
- হঠাৎ চোখে ঝাপসা দেখা, অন্ধকার লাগা বা চোখের সামনের কোন বস্তুর ডাবল প্রতিবিম্ব দেখা ইত্যাদিও স্ট্রোকের লক্ষণ হতে পারে।
- স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীরা অনেক সময় শর্ট টাইম মেমোরী লসে আক্রান্ত হন। তারা নিজের নাম মনে করতে পারেন না, পরিবারের লোকজনকে চিনতে সমস্যা হয়। এ ধরনের সমস্যায় অবশ্যই দ্রুত রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
উপরে আলোচনাকৃত যে কোন লক্ষণই হতে পারে স্ট্রোকের পূর্ব লক্ষণ আবার নাও হতে পারে। তবে যে করণেই হোক, শরীরে এ ধরনের অসুস্থতা বা অস্বাভাবিকতা বোধ হলে অবহেলা না করে অতি অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার এত বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে অসচেতনতা এবং অজ্ঞতা। তার মানে এ বিষয়ে কিছুটা সচেতনতা এবং সাধারণ জ্ঞান রাখলে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুঝুঁকি কিছুটা হলেও হ্রাস করা সম্ভব।
আশা করছি আজকের এ আলোচনা থেকে ব্রেইন স্ট্রোকের প্রধান লক্ষণগুলো জেনে সকলেই এ ব্যাপারে সচেতন থাকার চেষ্টা করবেন এবং অন্যদেরও জানাতে পারবেন।