বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জানুনধর্ম শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Religion. ধর্ম হলো সৃষ্টিকর্তার উপাসনা পদ্ধতি, আচার-আচরণ, ইহ ও পরকাল সম্পর্কিত নির্দেশ এর সমষ্টি। ধর্ম এমন এক বিশ্বাস যা মানুষ স্বীকার করে এবং সে বিশ্বাস অনুযায়ী তার জীবন পরিচালিত করে বা করার চেষ্টা করে। পৃথিবীর প্রাচীন কাল থেকে মানুষ ধর্ম মেনে চললেও তাদের সবার ধর্ম এক ছিল না। বিশ্বে অনেক ধর্ম প্রচলিত থাকলেও বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্মগুলো হলোঃ-
১. হিন্দু ধর্ম
২. বৌদ্ধ ধর্ম
৩. জৈন ধর্ম
৫. ইহুদি ধর্ম
৬. খ্রিষ্ট ধর্ম
৭. ইসলাম ধর্ম
এ পূর্বে আমাদের আলোচনার বিষয় হলো হিন্দু ধর্ম।
হিন্দু ধর্ম (Hinduism)
বিশ্বে প্রচলিত এবং সমাদৃত ধর্মসমূহের মধ্যে হিন্দু ধর্ম অন্যতম প্রধান ধর্ম। ভারতবর্ষে এ ধর্মের উৎপত্তি এবং পৃথিবীর শতাধিক কোটি হিন্দুর মধ্যে ভারতবর্ষেই প্রায় ৯৯% হিন্দু ধর্মাবলম্বী বসবাস করেন। এটি সনাতন ধর্ম হিসাবেও পরিচিত।
হিন্দু ধর্মের ভিত্তি (Basis of Hinduism)
হিন্দু ধর্মের প্রধান ভিত্তি হলো বেদ। এছাড়া বেদকে ভিত্তি করে রচিত গ্রন্থ গুলোও এর ভিত্তি। কেননা সেগুলোতে হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রয়েছে।
১. বেদ ঃ বেদ হিন্দু ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। এটি কোন পুরুষ কর্তৃক রচিত হয়নি বলে বেদকে অপৌরুষেয় বলা হয়। বেদের ৪ টি ভাগ রয়েছে। যথাঃ-
ক. ঋগবেদ
খ. সামবেদ
গ. যজুর্বেদ
ঘ. অথর্ববেদ
মহিষ কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস প্রত্যেকটি বেদকে ২ ভাগে বিভক্ত করেছেন। এগুলো হলোঃ-
i. সংহিতা – বেদের যে অংশে মন্ত্রসমূহ রয়েছে তাকে সংহিতা বলে।
ii. ব্রাহ্মণ – সংহিতার মন্ত্রসমূহের অর্থ ও ব্যাখ্যা যে অংশে থাকে তাকে ব্রাহ্মণ বলে।
২. উপনিষদ বা বেদান্ত ঃ যা মানুষকে ঈশ্বর বা ব্রাহ্মের কাছে নিয়ে যায় বা যা শিষ্য গুরুর কাছে এসে শিক্ষা নেয় তাই উপনিষদ। উপনিষদ বেদের শেষ অংশ বলে একে বেদান্ত বলা হয়।
৩. বেদাঙ্গ ঃ বেদের অর্থকে সঠিক ও কার্যকরভাবে বুঝার জন্য মুনি – ঋষিগণ যে ৬ টি বিশেষ গ্রন্থ রচনা করেছেন তাকে বেদাঙ্গ বলে।এগুলো হলো – শিক্ষা, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, জ্যোতিষ, কল্পসূত্র।
৪. উপবেদ ঃ মুনি – ঋষিগণ মানব জাতি ও সমাজের কল্যাণ ও মুক্তির নির্দেশনা দিতে বেশ কিছু লৌকিক শাস্ত্র রচনা করেন। এগুলোই উপবেদ হিসাবে খ্যাত। বেদের মত উপবেদেরও ৪ টি ভাগ রয়েছে। যেমন-
ক. আয়ূর্বেদ – ভেষজশাস্ত্র বা উদ্ভিদভিত্তিক চিকিৎসা বিষয়ক শাস্ত্র হলো আয়ূর্বেদ।
খ. ধনুর্বেদ – অস্ত্র তৈরি ও পরিচালনা তথা যুদ্ধ বিষয়ক শাস্ত্র হলো ধনুর্বেদ।
গ. গন্দর্ববেদ – সংগীত বিষয়ক উপবেদের নাম গন্দর্ববেদ।
ঘ. স্থাপত্যবেদ – কৃষি ও গৃহনির্মাণ সংক্রান্ত শাস্ত্র হলো স্থাপত্যবেদ।
৫. স্মৃতি সংহিতা ঃ যুগের চাহিদা, উপযোগিতা এবং পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখে যেসব শাস্ত্র মুনি – ঋষিগণ রচনা করেন তাকে স্মৃতি সংহিতা বা যুগশাস্ত্র বলা হয়।
৬. রামায়ণ ও মহাভারত ঃ মহর্ষি বাল্মীকি রামায়ণ এবং বেদব্যাস মহাভারত মহাকাব্যের মাধ্যমে বেদের সত্য, উপনিষদের তত্ত্ব, স্মৃতি সংহিতার অনুশাসন কাহিনী ও রূপকের মাধ্যমে সর্বসাধারণের নিকট তুলে ধরেন। মহাভারতকে হিন্দু ধর্মের বিশ্বকোষ এবং পঞ্চম বেদও বলা হয়।
৭. শ্রীমদভাগবদগীতা ঃ শ্রীমদভাগবদগীতা সংক্ষেপে গীতা নামেই প্রসিদ্ধ। এটি মহাভারত মহাকাব্যের অন্তর্গত হলেও বৈচিত্র্যের কারণে আলাদা ধর্মগ্রন্থ। চারটি বেদের সারতত্ত্ব হলো উপনিষদ আর উপনিষদের সার কথা নিয়ে রচিত হয়েছে গীতা। এ গ্রন্থটিতে হিন্দু ধর্মের গুঢ়তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে।
৮. পুরাণ ঃ মুনি – ঋষিগণ বেদের পুরাতন দার্শনিক ও সাধন তত্ত্ব নানা রকম কল্প – কাহিনী ও উপমার মাধ্যমে প্রচারের জন্য যে শাস্ত্র রচনা করেন তাই পুরাণ। পুরান ২ প্রকার। যথা- মহাপুরাণ, উপপুরাণ। উভয় প্রকার পুরাণ অষ্টাদশখানা করে।
৯. চণ্ডী ঃ গীতার মতোই এটি নিত্য পাঠ্য এবং অবশ্যই পালনীয় শাস্ত্র।
১০. আগম শাস্ত্র ঃ হিন্দু ধর্মে সম্প্রদায় ও বর্ণ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন আগম শাস্ত্র রয়েছে। যেমন –
ক. শৈব সম্প্রদায়ের আগম শাস্ত্রের নাম শৈবাগম।
খ. বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের আগম শাস্ত্রের নাম বৈষ্ণবাগম।
গ. শাক্ত সম্প্রদায়ের আগম শাস্ত্রের নাম শাক্তাগম বা তন্ত্র।
১১. ষড়দর্শন ঃ হিন্দু ধর্মে ছয়টি দর্শনকে ষড়দর্শন বলা হয়। এগুলো হলোঃ- সংখ্যা দর্শন, যোগ দর্শন, ন্যায় দর্শন, বৈশেষিক দর্শন, পূর্ব মীমাংসা দর্শন, উত্তর মীমাংসা বা বেদান্ত দর্শন।
হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of hinduism)
ধর্মসমূহের মধ্যে প্রাচীনতম হিন্দু ধর্ম নানা রকম বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত। এই ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলো হলোঃ-
১. একেশ্বরবাদীঃ হিন্দু ধর্মে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বা ভগবান হলেন পরম ব্রহ্ম আর তিনি এক ও অদ্বিতীয়। হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস করে যে, এক ঈশ্বর বহু ঈশ্বরের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করে। ঈশ্বরের আত্মপ্রকাশের এই রূপই হলো দেবতা।
২. অদ্বৈতবাদীঃ হিন্দু ধর্মে সৃষ্টিজগত ও সৃষ্টিকর্তাকে অভিন্ন মনে করা হয়। ব্রহ্মসূত্রে বলা হয়েছে, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ অর্থাৎ জীবই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই সব, জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। বেদান্ত দর্শনে আছে, “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” অর্থাৎ জগতের সবকিছুই ব্রহ্ম।
৩. বহুদেববাদীঃ কথায় বলে, “হিন্দু ধর্ম তেত্রিশ কোটি দেবতার ধর্ম”। বৈদিক যুগ থেকেই হিন্দুরা বহু দেবতার উপাসনা করে আসছেন। এ সকল দেবতা একই পরম সত্তার বিভিন্ন প্রকাশ। ব্রহ্মা, শিব, বিষ্ণু, অগ্নি, ইন্দ্র, কালী, দুর্গা, লক্ষ্মী, স্বরস্বতী, মনসা, শীতলা, ঊষা, বরুণ, রুদ্রগণ, সোম, সাবিতা, ইত্যাদি অন্যতম দেবতা।
৪. অবতারবাদীঃ ভগবান মানুষ ও অন্যান্য মূর্তি ধারণ করে পৃথিবীতে আগমন করা সংক্রান্ত মতবাদ হলো অবতারবাদ। ঈশ্বরের অবতার হিসাবে আবির্ভাবের উদ্দেশ্য মানব ও সৃষ্টিজীবের কল্যাণ সাধন। শ্রীবিষ্ণুর দশটি অবতার রূপ হিন্দু ধর্মে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এগুলো হলোঃ- মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রামচন্দ্র, বলরাম, বুদ্ধদেব এবং কল্কি অবতার।
৫. কর্মবাদীঃ কর্মবাদের মূলকথা হলো যে যেমন কাজ করবে সে তেমন ফল ভোগ করবে। অর্থাৎ ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ প্রবাদ বাক্য কর্মবাদেরই সারকথা।
৬. জন্মান্তরবাদীঃ জন্মান্তরবাদ বা পুনর্জন্মবাদ বলতে মৃত্যুর পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করা বুঝায়। হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস করে যে, মানুষের মৃত্যুর পর আত্মা দেহ পরিবর্তন করে আবার জন্মগ্রহণ করে। আত্মা শাশ্বত, চিরন্তন।
৭. বর্ণবাদীঃ প্রধানত জন্ম দ্বারা বর্ণ নির্ধারিত হয়। হিন্দু ধর্মমতে, গুণ ও কর্ম অনুসারে সমাজে বসবাসরত মানুষকে চারভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলোঃ-
ক) ব্রাহ্মণঃ পরম ব্রহ্মের মুখ থেকে এদের উৎপত্তি। আদর্শ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, বৈদিক কর্ম পরিচালনা করা এদের প্রধান কাজ।
খ) ক্ষত্রিয়ঃ পরম ব্রহ্মের বাহু থেকে ক্ষত্রিয়দের উৎপত্তি। ক্ষত্রিয়গণ হলেন শাসক বর্ণের লোক। দেশরক্ষা, দক্ষতা, সাহস, তেজ, যুদ্ধ পরিচালনা এগুলো ক্ষত্রিয়দের মূল কাজ।
গ) বৈশ্যঃ পরম ব্রহ্মের জানু থেকে বৈশ্যদের উৎপত্তি। কৃষিকাজ, বাণিজ্য, গোরক্ষা, উৎপাদন প্রভৃতি এদের মূল কাজ।
ঘ) শূদ্রঃ পরম ব্রহ্মের পদ থেকে শূদ্রদের উৎপত্তি। অন্য সকল বর্ণের লোকদের সেবা করাই শূদ্রদের মূল কাজ।
হিন্দুধর্মে মানুষের জন্মগত এই বর্ণপ্রথার পাশাপাশি ব্যক্তির জীবনের বিভিন্ন পর্যায়কে চারভাগে ভাগ করা হয়। এগুলোর প্রত্যেক ভাগকে আশ্রম এবং চারটিকে চতুরাশ্রম বলে। এগুলো হলোঃ-
ক) ব্রহ্মচর্যঃ ছাত্রজীবন।
খ) গার্হস্থ্যঃ সংসার জীবন।
গ) বানপ্রস্থঃ সংসার থেকে অবসর জীবন।
ঘ) সন্ন্যাসঃ ঈশ্বরের ধ্যানে মগ্ন হওয়ার জন্য সংসার ত্যাগী হওয়া।
৮. মোক্ষবাদীঃ মোক্ষ বলতে বুঝায় মহামুক্তি বা চূড়ান্ত মুক্তি। ভুল ধারনা ও মিথ্যা মায়ার প্রভাব ছিন্ন করে মানুষ যদি অনিত্যকে অনিত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলে জানতে পারে তাহলে মোক্ষ লাভের আশা করা যায়। মানুষ নিজ চেষ্টায়, অবিরাম সাধনা ও নিষ্কাম কর্মযোগে এক জীবনেই মোক্ষ লাভ করতে পারে।
৯. আশাবাদীঃ মানুষের জীবনে দুঃখ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। শাস্ত্রীয় নির্দেশনা মেনে এ দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। এ ধর্মে দুঃখ মুক্তির চারটি পথের কথা বলা হয়েছে। যথাঃ- জ্ঞান মার্গ, কর্ম মার্গ, যোগ মার্গ, ভক্তি মার্গ।
১০. ঈশ্বরের বিশেষ রূপঃ ঋগবেদের পুরুষ সূত্রে বলা হয়েছে, পরম পুরুষ জগৎ জুড়ে থেকেও তিনি বিশ্ব থেকে দশাঙ্গুল পরিমাণ অতিরিক্ত হয়ে আছেন। তিনি একদিকে জগৎব্যাপী, অপরদিকে তিনি জগতের ঊর্ধ্বে।
পরমতসহিষ্ণুতা এ ধর্মমতের প্রধান বৈশিষ্ট্য। হিন্দু ধর্মে আত্মসুখ ও ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে সকলকেই সমাজের সভ্য হিসাবে কর্তব্য করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ
বই- বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্ম
লেখক- ড. মোঃ ইব্রাহীম খলিল