কাবাঘর

হজ্জের নিয়ম কানুন

হজ্জ একটি আরবি শব্দ। হজ্জ শব্দের অর্থ হলো ইচ্ছা করা। শরীয়তের পরিভাষায় হজ্জ বলতে নির্দিষ্ট সময়, নির্দিষ্ট নিয়মে কাবাঘর যিয়ারত করার ইচ্ছা পোষনকে হজ্জ বলা হয়। হজ্জ একটি ফরজ ইবাদত হলেও ইহা সকলের জন্য ফরজ নয়। শুধুমাত্র যাদের হজ্জ করার সামর্থ্য রয়েছে তাদের উপর হজ্জ ফরজ।

হজ্জ ফরজ হওয়ার শর্ত

হজ্জ ফরজ হওয়ার শর্ত পূরণ হলে তাকে অবশ্যই হজ্জ করতে হবে। হজ্জ ফরজ হওয়ার শর্ত হচ্ছে-

  1. মক্কাশরীফ যাওয়া ও আসার যাবতীয় খরচের ব্যবস্থা থাকা।
  2. হজ্জের সফর করার সময় পরিবারের খরচ বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকা।
  3. হজ্জে যাওয়া ও আসাতে কোনরূপ প্রাণ হানীর আশংকা না থাকা।
  4. হজ্জে যেতে রাষ্ট্রীয় কোন বাধা না থাকা।
  5. প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক ও জ্ঞানের অধিকারী হওয়া।
  6. মহিলাদের জন্য উপরের শর্তগুলোর সাথে একজন মাহরাম(স্বামী,বাবা,ভাই,ছেলে) লোক থাকা।

হজ্জ কত প্রকার

হজ্জকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ- হজ্জে ইফরাদ, হজ্জে তামাত্তু, হজ্জে কেরান।

  • হজ্জে ইফরাদঃ কেউ যদি ওমরা ছাড়া শুধুমাত্র হজ্জের নিয়তে মক্কাশরীফে গমন করা তাকে হজ্জে ইফরাদ বলে।
  • হজ্জে তামাত্তুঃ কেউ যদি প্রথমে উমরার নিয়তে ইহরাম বেঁধে উমরার কাজ সম্পূর্ণ করে ও ইহরাম খুলে ফেলে এবং পরে নতুনভাবে ইহরাম বেঁধে হজ্জ আদায় করে তাকে হজ্জে তামাত্তু বলা হয়।
  • হজ্জে কেরানঃ কেউ যদি একই সাথে হজ্জ ও উমরার ইহরাম বাঁধে তবে তাকে হজ্জে কেরান বলা হয়।

হজ্জের ফরজ কয়টি

হজ্জের ফরজ ৩ টি। যথাঃ-

  1. ইহরাম বাঁধা।
  2. জিলহজ্জ মাসের ৯ম তারিখে আরাফার ময়দানে অবস্থান করা।
  3. জিলহজ্জ মাসের ১০ম তারিখে বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করা।

হজ্জের ওয়াজিব কয়টি

হজ্জের ওয়াজিব ৫ টি। এগুলো হলোঃ-

  1. মুজদালিফায় রাত্রি যাপন করা।
  2. সাফা-মারওয়া দৌড়ানো।
  3. মিনার জুমরাতে কংকর নিক্ষেপ করা।
  4. মস্তক হলক করা বা মাথা কামানো।
  5. বিদেশী হাজীদের জন্য বিদায়ী তাওয়াফ করা।

হজ্জের সুন্নাত সমূহ

  • ইমামের পিছনে আরাফার ময়দানে গমন করা।
  • তাওয়াফে কুদুম করা।
  • সাফা-মারওয়াতে সাতবার দৌড়ানো।
  • শয়তানের প্রতি নির্দিষ্ট সংখ্যক কংকর নিক্ষেপ করা।

ইহরাম বাঁধার পূর্বে করণীয়

ইহরাম বাঁধার পূর্বে খুব ভালো করে ক্ষৌরকর্ম করে নিতে হবে। অর্থাৎ হাত ও পায়ের নখ, নাভীর নিচের পশম ও বগলের পশম কেটে নিতে হবে। সম্ভব হলে ইহরাম বাঁধার পূর্বে গোসল করে নিবে। হজ্জ আদায়ের জন্যে নিয়ত করবে।

ইহরাম বাঁধা

সেলাইবিহীন ৫ হাত লম্বা ২ খন্ড পবিত্র সাদা কাপড়ের ১ খন্ড লুঙ্গীর মত করে পরিধান করতে হবে এবং অন্য খন্ড চাদরের মত শরীরে পরতে হবে। ইহরাম বাঁধার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ লোকের সাহায্য নেওয়া উচিত যদি নিজে পরিধানের সঠিক নিয়ম না জেনে থাকেন।

ইহরাম বাঁধার পর সম্ভব হলে ২ রাকাত সুন্নাত নামাজ আদায় করে নিবেন। ইহরাম বাঁধার পরে তালাবিয়া পাঠ করতে হবে।

তালাবিয়া কি

উচ্চারণ-“লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইকা, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুলকা, লা শারিকা লাকা”

অর্থ-“(হে আমার মালিক!) তোমার জন্য উপস্থিত হয়েছি হে আল্লাহ! তোমার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। আমি তোমার ডাকে সাড়া দিয়েছি। তোমার কোন অংশীদার নেই। নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদসমূহ তোমারই এবং সমগ্র বিশ্বের একচ্ছত্র আধিপত্য তোমারই, তোমার কোন অংশীদার নেই।”

 হজ্জের এই দোয়া পাঠ করাকে তালাবিয়া বলে। যেহেতু  হজ্জের এই দোয়া অনেক বেশী পাঠ করতে হয় সেহেতু হাজীদের উচিত অভিজ্ঞ আলেমের নিকট থেকে ইহার শুদ্ধ উচ্চারণ ও অর্থ শিখে নেওয়া।

ইহরাম বাঁধার পর যেসব কাজ করা যাবে না

  1. সেলাইযুক্ত কাপড় পরা যাবে না।
  2. মাথা ও মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা যাবে না।
  3. পায়ের উপরের অংশ ঢেকে যায় এমন জুতা ব্যবহার করা যাবে না।
  4. শরীরের কোন পশম কাটা বা ছেঁড়া যাবে না।
  5. হাত – পায়ের নখ কাটা যাবে না।
  6. সুগন্ধি তেল, আতর, সেন্ট ব্যবহার করা যাবে না।
  7. স্ত্রীর সাথে যৌন-মিলন বা যৌন উত্তেজনামূলক কোন আচরণ করা যাবে না।
  8. কোন পশু শিকার করা যাবে না।
  9. মশা, মাছি, উকুন, পিঁপড়া বা পোকা-মাকড় মারা যাবে না।
  10. যুদ্ধ, মারামারি, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি করা যাবে না।
  11. কোন গোনাহের কাজ করা যাবে না।

বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ

তাওয়াফ আরবী শব্দ এর অর্থ হচ্ছে কোন কিছুর চারদিকে প্রদক্ষিণ করা বা বৃত্তাকারে ঘোরা। ইসলামের নির্দেশিত নিয়মে কাবাঘর প্রদক্ষিণ করার নাম হলো তাওয়াফ। তাওয়াফ করার স্থাঙ্কে মাতাফ বলা হয়। কাবাঘরের যেখানে হাজরে আসওয়াদ পাথর রয়েছে তার ডান দিকে একটি সবুজ বাতি রয়েছে। পাথরে চুমু দিয়ে অথবা যদি চুমু দেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে পাথরের দিকে মুখ করে দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠিয়ে সবুজ বাতি বরাবর থেকে সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে তাওয়াফ শুরু করবে। এভাবে ঘুরে এসে আবার সবুজ বাতি পর্যন্ত পৌঁছলে এক চক্কর পূর্ণ হবে। আর এভাবে সাত চক্কর পূর্ণ হলে একবার তাওয়াফ হয়েছে বলে গণ্য হবে।

তাওয়াফের আদব

  • তাওয়াফ করার সময় কথা না বলা।
  • তাওয়াফ করার ধাক্কাধাক্কি না করা।
  • পাথরে চুমু দেওয়া সুন্নাত। তবে চুমু দিতে গিয়ে কেউ কষ্ট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে না দেওয়া উত্তম।
  • ইচ্ছাকৃতভাবে কোন নারী-পুরুষ একে অপরকে স্পর্শ করা যাবে না।

তাওয়াফের দোয়া

উচ্চারণঃ “সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার। ওয়া লা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিইল আযিম। ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম”

অর্থঃ “মহান আল্লাহ পবিত্র এবং যাবতীয় প্রশংসা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য। আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, আল্লাহ মহান। আল্লাহই একমাত্র শক্তিশালী যিনি মহান ও পবিত্র, তার তাওফীক ব্যতীত আমার নিজের শক্তি সামর্থ্য কিছুই নেই। দরুদ ও সালাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য।”

তাওয়াফের স্থান দোয়া কবুল হওয়ার স্থান। প্রত্যেক চক্করে উপরের এই দোয়া পাঠ করতে হবে। প্রতি চক্কর পূর্ণ হওয়ার সময়(সবুজ বাতির কাছাকাছি আসলে) নিচের দোয়াটি পড়তে হবে-

উচ্চারণঃ “রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসানাতাঁও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাঁও ওয়া কিনা আযাবান নার, ওয়াদ খিলনাল জান্নাতা মাআল আবরার, ইয়া আযিযু ইয়া গাফফার, ইয়া রাববিল আলামিন”

অর্থঃ হে আমাদের রব। আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ দান করো। আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তি দাও। এবং আমাদেরকে তোমার জান্নাতে প্রবেশ করাও। হে মহাশক্তিমান, মহাপরাক্রমশালি! হে ক্ষমাকারী! হে সমগ্র সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা প্রতিপালক!

উপরোক্ত দোয়াগুলোর শুদ্ধ উচ্চারণ ও অর্থ শিখে নিতে হবে। এছাড়াও তাওয়াফের সময় অন্য যেকোন দোয়া করা যেতে পারে।

মাকামে ইবরাহীম

তাওয়াফ শেষ হলে মাকামে ইবরাহীমের পেছনে এসে ২ রাকাত ওয়াজিবুত তাওয়াফ নামাজ আদায় করতে হবে। তবে মাকামে ইবরাহীমে ভীড়ের কারণে সমস্যা হলে আল্লাহর ঘরের অন্য যেকোন স্থানে গিয়ে নামাজ আদায় করতে হবে।

জমজমের পানি পানের নিয়ম

জমজমের পানি পানের সময়ও ধাক্কাধাক্কি করা যাবে না। অন্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে পানি পান করতে হবে। বিসমিল্লাহ বলে তিন নিশ্বাসে পানি পান করতে হবে। ইহা অনেক বরকতময় পানি। এসময় যেকোন দোয়া করা যেতে পারে। পানি পান শেষে আল-হামদুলিল্লাহ বলতে হবে।

সাফা মারওয়া সাঈ করা

সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত এক এবং মারওয়া থেকে সাফা পর্যন্ত এলে দুই। এভাবে সাতবার আসা-যাওয়া করলে ১ সাঈ সম্পূর্ণ হবে। সাঈ করার সময় বিভিন্ন দোয়া রয়েছে সেগুলো পড়বে এবং নিজের ভাষাতে যেকোন দোয়া করবে।

মাথার চুল কাটা

হজ্জ ও উমরা করার সময় চুল কাটা ওয়াজিব। যারা উমরা করে তারা সাঈ করার পর চুল কাটবেন আর হাজীরা কুরবানীর পরে মিনায় চুল কাটবেন। মহিলারা শুধু চুলের মাথা এক আঙ্গুল পরিমাণ কাটবেন।

মিনা ও আরাফাতের  ময়দানে অবস্থান

জিলহজ্জ মাসের ৭ তারিখ রাতে মক্কা থেকে ইহরাম বেঁধে মিনায় গিয়ে অবস্থান করতে হবে। ৮ তারিখ ফজর থেকে এশা পর্যন্ত ৫ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করতে হবে। ৯ ই জিলহজ্জ তারিখে মিনা থেকে এমন সময় আরাফাতের দিকে রওয়ানা করতে হবে যেন সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার আগেই আরাফাতের ময়দানে পৌছানো যায়। কেউ চাইলে ৮ তারিখ এশার নামাজ আদায় করে রাতেই রওয়ানা করতে পারবে। তবে ৯ তারিখ ফজর নামাজ আদায় করে অবশ্যই রওয়ানা করতে হবে। যেতে যেতে তালাবিয়া পাঠ করতে হবে। ৯ তারিখ সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার সময় থেকে সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা ফরজ। আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের ফজিলত অনেক। তাই এখানে বেশি বেশি দোয়া করতে হবে।

মুযদালিফা

আরাফাতের ময়দান থেকে হাজীরা তালাবিয়া পড়তে পড়তে মুযদালিফাতে আসবে। এখানে এশার নামাযের ওয়াক্তে মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে আদায় করতে হবে। মুযদালিফায় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হবে।

পাথর নিক্ষেপ করা

মুযদালিফা থেকে ১০ ই জিলহজ্জ ফজরের নামাজ আদায় করে তালাবিয়া পাঠ করতে করতে মিনায় জামরাতুল আকাবা(জামরাতুল কুবরা) তে যাবেন। এখানে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করতে হবে।

১১, ১২ ও ১৩ ই জিলহজ্জ তারিখেও প্রতি জামরাতে সাতটি করে তিন জামরাতে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। অর্থাৎ এই তিনদিনে মোট ৬৩ টি পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। আগের ৭ টি সহ সর্বমোট ৭০ টি পাথর নিক্ষেপ করতে হবে।

কুরবানী ও মাথা মুন্ডন এবং তাওয়াফ

১০ ই জিলহজ্জ তারিখে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করে কুরবানী করতে হবে। এরপর মাথা মুন্ডন করে ইহরামের কাপড় ছেড়ে অন্য পোশাক পরিধান করতে হবে। ১০ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত পাথর নিক্ষেপ শেষে বিদায় তাওয়াফ ও সাঈ আদায় করে মক্কা ত্যাগ করতে হবে।

মসজিদে নববী ও রওজা মোবারক যিয়ারত

হজ্জ আদায় শেষ করে হাজীরা মক্কা থেকে মদিনাতে গমন করেন। এখানে ঘুমিয়ে আছেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) ও অনেক সাহাবি। মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করা সুন্নাত। এখানে নামাজ আদায় করলে অনেক বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়।

মসজিদে নববীর পাশেই রাসূল (স.) এর রওজা মোবারক। এখানে যেসব কাজ করা যাবে না-

  • উচ্চস্বরে কাঁদা
  • সিজদা দেওয়া
  • মাটিতে গড়া-গড়ি দেওয়া ইত্যাদি

রাসূলের প্রতি সালাম দিয়ে দুরূদ পাঠ ও দোয়া করতে হবে। রাসূলের পাশেই ঘুমিয়ে আছেন আবু বকর ও উমর (রা.) তাদের কবর যিযারত করে জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে সাহাবায় কেরামের কবর যিয়ারত করা যাবে।

হজ্জ যেহেতু ফরজ ইবাদত সেহেতু এর সকল নিয়ম-কানুন হজ্জের পূর্বেই অভিজ্ঞ আলেমের নিক্ট থেকে জেনে নিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক নিয়মে হজ্জ আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *