পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম অন্যতম। এই ধর্মের প্রচারক মহামতি গৌতম বুদ্ধ। তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দুঃখ দুর্দশা থেকে মানুষের পরিত্রাণের পথ। আবিষ্কার করা এবং মানুষকে ঐ পথের নির্দেশ দেওয়া। যা তিনি ত্রিপিটক ও চারটি আর্যসত্যের মধ্যে বর্ণনা করেছেন। গৌতম বুদ্ধ ঈশ্বর পূজার কেন্দ্র হতে ধর্মকে সরিয়ে এনে মানুষের সেবায় সংস্থাপন করেন। বৌদ্ধ ধর্মে নির্বাণই পরম সত্য নির্বাণই পরম লক্ষ্য।
বৌদ্ধ ধর্মের বৈশিষ্ট্য(Characteristics of Buddhism)
১. ঈশ্বর নিরপেক্ষঃ বৌদ্ধ ধর্ম মতে, নৈতিক অগ্রগতি বা পূর্ণতা অর্জনের জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা আবশ্যক নয়। কারণ ঈশ্বরের অস্তিত্বের ধারণা ও তার অসীম ক্ষমতায় বিশ্বাস মানুষকে নিষ্ক্রিয় ও দায়িত্বহীন করে তোলে।
২. কর্মবাদীঃ “যেমন কর্ম তেমন ফল” প্রবাদ বাক্যের মতই কর্মের ফল ভোগ করতে হবে। এই ফল যদি এক জীবনে শেষ না হয় তাহলে কর্মফল ভোগ করার জন্যই মানুষকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। গৌতম বুদ্ধের মতে, নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে পুনর্জন্ম রোধ করতে পারলেই দুঃখ থেকে চিরমুক্তি লাভ সম্ভব।
৩. ইচ্ছার স্বাধীনতার স্বীকৃতিঃ বৌদ্ধ ধর্মে ইচ্ছার সর্বোচ্চ স্বাধীনতার কথা স্বীকার করা হয়। বৌদ্ধ দর্শনে ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কিত নিয়ন্ত্রণবাদ ও অনিয়ন্ত্রণবাদকেও স্বীকার করা হয়না। ইচ্ছার স্বাধীনতার সর্বোচ্চ প্রয়োগের জন্য এ দর্শনে স্বনিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়।
৪. আত্মা নিরপেক্ষঃ বুদ্ধদেবের মতে, সব কিছুই অনিত্য ও ক্ষণকালের। তাই চিরন্তন আত্মার অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। গৌতম বুদ্ধ নৈরাত্মবাদের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
৫. প্রত্যক্ষবাদীঃ বৌদ্ধ ধর্মমতে যা মানুষ প্রত্যক্ষ করতে পারে তাই সত্য। আর যা প্রত্যক্ষ করতে পারে না তা সত্য নয়। তাই ঈশ্বর, আত্মা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনাকে এখানে নিরুৎসাহিত করা হয়। মানুষের দুঃখ কষ্ট প্রত্যক্ষণযোগ্য তাই এটি সত্য।
৬. প্রয়োজনবাদীঃ বৌদ্ধ ধর্মে মানুষের প্রয়োজনকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। গৌতম বুদ্ধ দেখেছেন মানুষ রোগ, শোক, জরা ইত্যাদি দুঃখে নিপতিত। তাই তিনি দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে আর্যসত্য ও অন্যান্য দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
৭. তত্ত্বালোচনা বিরোধীঃ বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব আলোচনায় মত্ত হতে একেবারেই অনাগ্রহী। আত্মা কি, ঈশ্বর সসীম নাকি অসীম, জগৎ নিত্য নাকি অনিত্য ইত্যাদি আলোচনা গৌতম বুদ্ধ একেবারেই অ-প্রয়োজনীয় মনে করতেন। তার মতে, এসকল প্রশ্ন নিরর্থক।
৮. দুঃখ মুক্তিই লক্ষ্যঃ মহামতি বৌদ্ধ বলেছেন, সর্বং দুক্খং বা সবই দুঃখময়। মানুষের জীবনে রয়েছে নানা রকম দুঃখ। প্রিয় বিচ্ছেদ, আতঙ্ক, হতাশা প্রভৃতি দুঃখ থেকে নির্বাণ লাভের মাধ্যমে মুক্তি লাভ করা সম্ভব।
৯. নির্বাণ চূড়ান্ত গন্তব্যঃ নির্বাণ হলো পূর্ণ বিলুপ্তি, শাশ্বত আনন্দের অবস্থা, অচিন্তনীয় অবস্থা এবং অপরিবর্তিত অবস্থা।
১০. মধ্যপন্থিঃ বৌদ্ধ ধর্ম চরমপন্থি নয়। এতে অসংযত ইন্দ্রিয় ভোগ নেই ও অনাবশ্যক কৃচ্ছতা সাধনও নেই। তাই একে মধ্যপন্থি ধর্ম বলা যায়।
১১. বৌদ্ধ সম্প্রদায়ঃ বৌদ্ধ সম্প্রদায় দুইভাগে বিভক্ত।যথাঃ-
ক) হীনযানঃ এরা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পালনীয় আচার-ব্যবহারের কঠোরতা শিথিল করার বিরোধী।
খ) মহাযানঃ মহাযানীরা আত্নমুক্তির কথা প্রচার না করে সকলের মুক্তির কথা বলেন।
প্রকৃতপক্ষে দুটি সম্প্রদায় ধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষায় কাজ করে চলছে।
ত্রিপিটক( Tripitaka ):
বৌদ্ধ ধর্মের মূলভিত্তি ত্রিপিটক। এখানে মহামতি গৌতম বুদ্ধের উপদেশ, বাণী ও শিক্ষার কথা রয়েছে। ত্রিপিটক তিনটি খণ্ডের সমষ্টি। এগুলো হলোঃ
১. বিনয় পিটকঃ বিনয় পিটকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুদের আচারণ সংক্রান্ত নিয়মের কথা বলা হয়েছে।
২. সুত্ত পিটকঃ এই পিটকে শিষ্যদের সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের আলাপচারিতা তুলে ধরা হয়েছে।
৩. অভিধম্ম পিটকঃ এখানে ধর্ম সম্পর্কিত ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, ভাষা প্রভৃতি সংযোজিত হয়েছে।
উল্লেখ্য প্রতিটি পিটকের বিষয় ভিত্তিক বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। ত্রিপিটক পাঠে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।
আর্যসত্য( Noble Truth ):
মানুষের জীবনের বাস্তব চারটি সত্যের সন্ধান দিয়েছেন গৌতম বুদ্ধ। এগুলোই আর্যসত্য নামে পরিচিত। এগুলো হলোঃ
১. জীবন দুঃখময়;
২. দুঃখের কারণ আছে;
৩. দুঃখের নিবৃত্তি আছে;
৪. দুঃখ নিরোধের উপায় আছে।
এই আর্যসত্যগুলোর ব্যাখ্যাও তিনি বর্ণনা করেছেন।
নির্বাণ লাভের উপায়:
দুঃখ-কষ্ট থেকে চিরমুক্তির জন্য নির্বাণ লাভ করতে হবে। নির্বাণ লাভের অনেক উপায় বা পদ্ধতি এবং ধাপ রয়েছে। এছাড়া দশটি নিষেধ কর্ম থেকে বিরত থাকতে হবে। এগুলো হলোঃ
১. প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ;
২. চুরি করা নিষিদ্ধ;
৩. কামাচার নিষিদ্ধ;
৪. মিথ্যা বলা নিষিদ্ধ;
৫. ক্ষতিকর ও দুর্বোধ্য কথা নিষিদ্ধ;
৬. কটুকথা নিষিদ্ধ;
৭. নিরর্থক কথা বলা নিষিদ্ধ;
৮. পরদ্রব্যে লোভ করা নিষিদ্ধ;
৯. হিংসা করা নিষিদ্ধ এবং
১০. বিপরীত জ্ঞান অর্জন নিষিদ্ধ।
নির্বাণ সম্পর্কে ত্রিপিটকে বলা হয়েছে-
“নিব্বানং পরমং সুখং
নিব্বানং পরমং সচ্চং
নিব্বানং অমৃতং পদং।”
তথ্যসূত্রঃ
বই- বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্ম
লেখক- ড. মোঃ ইব্রাহীম খলিল