পারসিক ধর্মপ্রবর্তক জরথুস্ত্র নামের ব্যক্তি প্রবর্তিত ধর্ম জরথুস্ত্র(Zoroastrianism) বা জরথ্রুস্ট ধর্ম হিসাবে খ্যাত। জরথুস্ত্র ধর্মের অনুসারীগণ বিশ্বাস করেন, মূর্তিপূজার অধর্ম ও আচার-অনুষ্ঠানের অসারতা এবং নানা ধরনের অনাচার ও পাপাচার থেকে মানব জাতিকে রক্ষার জন্য জরথুস্ত্রের মাধ্যমে মহান সৃষ্টিকর্তা এই ধর্ম প্রেরণ করেছেন।
জরথুস্ত্র ধর্মের বৈশিষ্ট্য
১. একেশ্বরবাদীঃ জরথুস্ত্রবাদ একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম। এখানে আহুরামাযদাকে(Ahura Mazda) একমাত্র ঈশ্বর বলে গণ্য করা হয়।
২. আহুরামাযদার পূজারীঃ জরথুস্ত্রবাদে আহুরামাযদাকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করা হয়। এই আহুরামাযদা নিরাকার এবং সর্বপ্রকার কল্যাণের নিয়ামক। আগুনের মাধ্যমে তার উপাসনা করা হয়।
৩. ঈশ্বরের দ্বৈতরূপঃ জরথুস্ত্র ধর্ম অনুসারে পৃথিবীটা একটা যুদ্ধ ক্ষেত্র। এখানে ভালো ঈশ্বর ও মন্দ ঈশ্বর থাকেন। ভালো ঈশ্বর ভালো কাজ করেন আর খারাপ কাজের জন্য দায়ী মন্দ ঈশ্বর।
৪. পরম স্বাধীনতাঃ এই ধর্মে ব্যক্তি নিজের ইচ্ছায় সৎকর্মের ঈশ্বর বা মন্দ কর্মের ঈশ্বরকে গ্রহণ করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে ব্যক্তি পুরোপুরি স্বাধীন।
৫. মৃত্যু পরবর্তী জীবনঃ জরথুস্ত্র ধর্মে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস স্থাপন করার কথা বলা হয়। অর্থাৎ এ ধর্মমতে মৃত্যুই জীবনের শেষ নয়। পার্থিব জীবনের পর যে জীবন শুরু হয় সে জীবন অশেষ ও মূল জীবন।
৬. সৃষ্টিকর্তার দূতঃ জরথুস্ত্র ধর্মমতে, মহান সৃষ্টিকর্তা তার বাণী পৌছানো, বিভিন্ন কাজ করা, শাস্তি কার্যকর করা প্রভৃতির জন্য বিশেষ দূত সৃষ্টি করেছেন। যেমন- বহুমনু আহুরামযদার একজন বিশেষ দূত।
এছাড়াও এ ধর্মের আরো অনেক বৈশিষ্ট রয়েছে। তার মধ্যে মরদেহের সৎকার, ভিক্ষাবৃত্তি মহাপাপ, শুভ শক্তির বিজয় অবশ্যম্ভাবী, আগুনের পবিত্রতা, আত্মার অবিশ্বরতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে ধারণা
জরথুস্ত্র ঘোষণা করেন, “আলো-আঁধার, মঙ্গল-অমঙ্গল যেমন পৃথক ধারার দুটি সৃষ্টি, তেমনি ভিন্ন ধারার এই সৃষ্টি দুটির স্রষ্টাও দু’জন। এরা হলেন আহুরামাযদা ও আহরিমান। আহুরামাযদাই হচ্ছেন একমাত্র প্রভু এবং মানুষের অবশ্য কর্তব্য হলো তাঁর উপাসনা ও পূজা করা।”
আহুরামাযদা কল্যাণের ঈশ্বর, সৎ ও সুন্দরের ঈশ্বর। সূর্য ও আগুনের রূপ ধরে তিনি দেখা দেন। সেজন্য আগুনের মাধ্যমে তার উপাসনা করা হয়। আহুরামাযদার সাহায্যকারী সাতজন ক্ষুদ্র দেবতা রয়েছেন।
জরথুস্ত্রবাদে অমঙ্গল, অসত্য, অকল্যাণ, অসৎ ও মিথ্যার সৃষ্টিকর্তা হলেন আহরিমান। পৃথিবীতে বিদ্যমান সকল পাপের জন্যে তিনি দায়ী। আহুরামাযদা ও আহরিমানের মধ্যে চলে নিরন্তর লড়াই। তবে একদিন ধ্বংস হবে আহরিমান ও তার অপশক্তি।
সমাজ জীবন সম্পর্কে ধারণা
জরথুস্ত্র ধর্মে সামাজিক জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন নির্দেশনা রয়েছে। এই ধর্মে বিবাহকে আবশ্যক মনে করা হয়। সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সামাজিক সদাচার ও মানব সেবা এবং জীবপ্রেম কথা বলা হয়েছে। এখানে বাজারকে নিকৃষ্ট স্থান বিবেচনা করা হলেও প্রয়োজনে সেখানে যাওয়া যাবে। সংসার জীবন আবশ্যক এবং যাবতীয় অনাচার(চুরি, ব্যাভিচার, সুদ, জুয়া, মদ্যপান) অবশ্যই বর্জন করতে হবে। জীবিকার্জনের উপায় হিসাবে কৃষিকাজ করা ও তাতে সেচ ব্যবস্থা করা এবং জমি পতিত না রাখার কথা বলা হয়েছে। মৃতদেহ সৎকার করার ব্যাপারে লোকালয় থেকে দূরে নির্মিত টাওয়ারে রেখে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
জরথুস্ত্র ধর্মে ব্যক্তিক শিক্ষা, পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা, অর্থনৈতিক শিক্ষা, দানশীলতা, সময় সম্পর্কে শিক্ষা এবং পারলৌকিক বা আধ্যাত্মিক শিক্ষার বর্ণনা রয়েছে। এটি একটি প্রাচীনতম ধর্ম হলেও ইরান ও ভারতের বোম্বে ও মহারাষ্ট্রে কিছু কিছু জরথুস্ত্র ধর্মের অনুসারী বাস করেন।
তথ্যসূত্র-
বইঃ বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্ম
লেখকঃ ড. মোঃ ইব্রাহীম খলিল