মোশী প্রবর্তিত ধর্মই ইহুদি ধর্ম(Judaism) এবং তার অনুসারীগণই ইহুদি। ইসলাম ধর্মে মোশী হযরত মূসা (আ) হিসাবে খ্যাত। ইহুদি ধর্মের অনুসারীগণ জ্যাকবের বংশধর। তাঁর এক নাম ইসরাঈল। এ জন্য ইহুদি ধর্মের অনুসারীগণ ইসরাঈলী নামে খ্যাত।
ইহুদি ধর্মের বৈশিষ্ট্য
প্রায় ৪ হাজার বছরের ইতিহাসে ইহুদি জনগণ এবং ইহুদি ধর্মের মধ্যে নানা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ইহুদি ধর্মের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলো হলো-
১. একত্ববাদীঃ ইহুদি ধর্ম একত্ববাদী। এ ধর্মে মহান সৃষ্টিকর্তা এক ও একক – এই বিশ্বাস সুদৃঢ়ভাবে পোষণ করা হয়। Old Testament – এ মহান সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, “উপাসনার যোগ্য একমাত্র তিনি। মহাবিশ্ব তাঁর সৃষ্টি। তিনি স্রষ্টা। সকলকে তাই তাঁর উপাসনাই করতে হবে।”
২. কর্মবাদীঃ ইহুদি ধর্মে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা স্বীকৃত। এ ধর্মের শিক্ষা অনুসারে কোনো করতে কাউকে বাধ্য করা হয়নি। ইচ্ছা করলে মানুষ সুপথে চলতে পারে বা বিপথে যেতে পারে। তবে তার কর্ম অনুসারে পরকালীন পরিণতি নির্ধারিত হবে।
৩. পুনরুত্থানবাদীঃ ইহুদিরা বিশ্বাস করে, মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষ একটি অশেষ জীবনে প্রবেশ করে। এখানে মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষের কর্মের বিচারের মাধ্যমে স্বর্গ বা নরক দিবেন।
৪. প্রত্যাদেশবাদীঃ ইহুদিরা স্বীকার করেন, মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাই তাদের আদেশ-নিষেধ অবশ্য পালনীয়।
৫. সেবাধর্মীঃ ইহুদি ধর্ম সৃষ্টিসেবাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। নিজের স্বার্থ বা সুবিধার চেয়ে অন্যের স্বার্থ বা সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
৬. ন্যায়বাদীঃ ইহুদি ধর্মে ন্যায়পরায়ণ হওয়া আবশ্যক ঘোষণা করে। সততা, কর্তব্যপরায়ণতা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা ইহুদি ধর্মে অনিবার্য মানবীয় গুণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
৭. সংসারবাদীঃ ইহুদি ধর্মে বিবাহ আবশ্যক। প্রয়োজনে বহুবিবাহের অনুমতিও রয়েছে। সংসারত্যাগী বৈরাগ্য জীবন ইহুদি ধর্ম সমর্থন করে না।
৮. মসীহবাদীঃ ইহুদিরা বিশ্বাস করেন, পৃথিবী ধ্বংসের আগে পৃথিবী যখন পাপে নিমজ্জিত থাকবে তখন সকলের পরিত্রাণকারী হিসাবে মসীহ আবির্ভূত হবেন এবং সকলকে পাপ থেকে উদ্ধার করে পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন।
৯. উপাসনাবাদীঃ ইহুদিরা জেরুজালেমমুখী হয়ে উপাসনা করে। তাদের উপাসনালয়ের নাম সিনাগগ।
১০. বর্ণবাদীঃ ইহুদিরা এক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণবাদী। জন্মগতভাবে ইহুদি না হলে কেউ এ ধর্ম গ্রহণের অধিকার নেই।
ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ
ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থের নাম তাওরাত। এটি হিব্রু ভাষায় নাযিলকৃত। ইহুদিদের ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে তাওরাত বাইবেলের পুরাতন অংশ। এ হিসাবে তারা একে ‘Old Testament’ হিসাবে অভিহিত করে থাকে।
জেহোভার সঙ্গে সম্পাদিত দশ চুক্তি
ইহুদিগণ সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা হিসাবে যে এক ও একক সত্তায় বিশ্বাস পোষণ করেন তাঁর নাম জেহোভা। জেহোভা ইহুদিদেরকে দশটি বিশেষ কাজের আদেশ দেন এবং এগুলো করার ব্যপারে তাদের নিকট থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন। ইহাই জেহোভার সঙ্গে সম্পাদিত দশ চুক্তি হিসাবে খ্যাত। চুক্তি গুলো হলোঃ
১. একমাত্র জেহোভার উপাসনা করা।
২. মাতা-পিতার সাথে সদাচার করা।
৩. অত্মীয়গণের সঙ্গে সদাচার করা।
৪. অনাথদের সঙ্গে সদাচার করা।
৫. অভাবীর সঙ্গে সদাচার করা।
৬. সত্যর পথে আহব্বান করা।
৭. মোশীর উপাসনা পদ্ধতির স্বীকার।
৮. দান-খয়রাত করা।
৯. রক্তপাত না করা।
১০. দেশান্তকরণ নিষিদ্ধ।
ইহুদি ধর্ম ও ইসলাম
ইহুদি ধর্মের সাথে ইসলাম ধর্মের কিছু জিনিসের মিল রয়েছে। তবে আবার অনেক অমিল ও রয়েছে। ইসলামী বিশ্বাসে, ইহুদি ধর্ম ইসলামের পূর্বসূরি ধর্ম হলেও বর্তমানে এ ধর্মে অনেক কিছু সংযোজন, বিয়োজন করা হয়েছে।
সাদৃশ্য
১. ইহুদি ধর্মাবলম্বীকে অবশ্যই সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও কর্তব্যপরায়ণ হতে হয়। ইসলামেও এগুলো আবশ্যক কর্ম।
২. ইহুদি ধর্মে স্রষ্টার নিকট সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করতে হয়। ইসলামে ধর্মেও আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করতে হয়।
৩. ইহুদি ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ তেমনি ইসলাম ধর্মেও সুদ হারাম।
৪. ইহুদি ধর্মে মানুষকে প্রভুর গুণে গুণান্বিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ইসলামেও একই নির্দেশ রয়েছে।
৫. ইহুদি ধর্মে সৃষ্টির প্রতি সদয় ও বিনয়ী থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে। ইসলামে তা আবশ্যক।
৬. ইহুদি ধর্মে প্রেরিত মহাপুরুষদের অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। ইসলাম ধর্মেও নবী-রাসূলদের অনুসরণের কথা বলা হয়েছে।
৭. ইহুদি ধর্মে উপবাস, প্রার্থনা, পশু উৎসর্গ করা হয়। ইসলাম ধর্মেও রোজা, নামাজ, কুরবানীর মাধ্যমে তা করা হয়।
৮. ইহুদি ধর্মে নিজের জন্য যা পছন্দ তা-ই অন্যের জন্যও পছন্দ করতে হবে। ইসলামেও এটি করা হয়।
৯. ইহুদি ধর্মে নিজের মঙ্গল কামনার পাশাপাশি অন্যের মঙ্গল কমনা করতে নির্দেশ আছে। ইসলামেও মহানবী (স) বলেছেন, “আল্লাহ তাকে দয়া করেন না যে মানুষের প্রতি দয়া করে না।”
১০. ইহুদি ধর্মে দরিদ্রকে অন্ন দেওয়া, অনাথ, এতীম ও অসহায়দের প্রতি সদয় হওয়া, ব্যভিচারকে মহাপাপ ঘোষণা করা হয়েছে। যা ইসলামে ধর্মেও করা হয়েছে।
বৈসাদৃশ্য
১. ইহুদি ধর্মে হযরত মূসা (আ)- কে শ্রেষ্ঠ নবী বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে, ইসলাম ধর্মে হযরত মুহাম্মদ (স)- কে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হিসাবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা হয়।
২. ইহুদি ধর্মে প্রয়োজন ও চাহিদা অনুসারে ধর্মযাজকগণ তাওরাতের বিধিবিধান পরিবর্তন করতে পারবে। অন্যদিকে ইসলাম ধর্মে কুরআন মাজীদের বিধান পরিবর্তন আনার ক্ষমতা কারো নেই।
৩. ইহুদিরা দৈনিক ৩ বার নামাজ পড়েন। অন্যদিকে মুসলমানগণ দৈনিক ৫ বার নামাজ পড়েন।
৪. শনিবার ইহুদিদের পবিত্র দিন। অন্যদিকে শুক্রবার মুসলমানদের পবিত্র দিন।
৫. জন্মগতভাবে ইহুদি না হলে কেউ ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে না। অন্যদিকে যে কেউ ইচ্ছা করলেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে।
৬. ইহুদিরা কখনও অন্য ধর্মের উপাসনালয়ে প্রবেশ করে না। মুসলিমরা প্রয়োজনে প্রবেশ করতে পারবে।
৭. ইহুদি ধর্মে সামান্য ন্যায়ের সীমা অতিক্রম করলেই তাকে মহাপাপ হিসাবে গন্য করা হয়। অন্য দিকে ইসলাম অনেক বেশি উদারপন্থি।
৮. ইহুদি ধর্মের বিশ্বাস অনুসারে, পৃথিবীতে ইহুদিরাই পৃথিবীর একমাত্র কল্যাণকামী জাতি। অন্যদিকে ইসলামের বিশ্বাস হলো, বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জাতি হলেন মুসলিমগণ।
৯. ইহুদি ধর্মে আচার-অনুষ্ঠান পালনে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল ও কঠোর। কিন্তু ইসলাম অনেক বেশি নমনীয় এবং সহনশীল।
বস্তুত ইহুদি ধর্ম ইসলামের পূর্ববর্তী রূপ। হযরত মূসা (আ) এর উপর নাযিলকৃত তাওরাত কিতাবকে ইহুদিরা বিশ্বাস করে এবং এই কিতাবে তাদের প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তন করা হয়। এজন্য ইসলামের সাথে কিছু জিনিসের মিল থাকলে পরিবর্তনের কারণে অমিল দেখা যায়।
তথ্যসূত্র-
বইঃ বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্ম
লেখকঃ ড. মোঃ ইব্রাহীম খলিল