আরবী ‘কুরবান’ শব্দটি ফারসী বা উর্দুতে ‘কুরবানী’ রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ ‘নৈকট্য’। পশু কুরবানীর মাধ্যমে মনের পশুকে কুরবানী করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। ১০ ই জিলহজ্জ ঈদের নামাজের পর থেকে ১২ ই জিলহজ্জ সূর্যস্ত পর্যন্ত কুরবানী করা যায়। তবে প্রথম দিন করা উত্তম। kurbani ki
কুরবানীর গুরুত্ব
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন-
১. অর্থঃ “আর কুরবানীর পশু সমূহকে তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। অতএব (কুরবানী করার সময়) তাদের (সারিবদ্ধভাবে) দাঁড় করিয়ে তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালার নাম নাও। অতপর (যবাই শেষে) তা যখন একদিকে পড়ে যায় তখন তোমরা তার (গোশত) থেকে নিজেরা খাও, যারা এমনিই (আল্লাহর রিজিকে) সন্তুষ্ট আছে তাদের এবং যারা (তোমার কাছে) সাহায্যপ্রার্থী হয়, এদের সবাইকে খাওয়াও; এভাবেই আমি এদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছি, যাতে তোমরা ( এ জন্যে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করতে পারো।” (সূরা হজ্জ ৩৬)
২. অর্থঃ “আর আমি তার (ছেলের) পরিবর্তে (আমার নিজের পক্ষ থেকে) একটা বড় কুরবানী (-র জন্তু সেখানে) দান করলাম। (অনাগত মানুষদের জন্য এ বিধান চালু রেখে) তার স্মরণ আমি অব্যাহত রাখলাম।” (সূরা ছফফাত ১০৭-১০৮)
৩. অর্থঃ “তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্য সালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর।” (সূরা কাওছার ০২)
এছাড়াও পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় কুরবানীর কথা বলা হয়েছে। তাই সামর্থ্যবান ব্যক্তির কুরবানী অবশ্যই করতে হবে।
কুরবানীর উদ্দেশ্য
কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য আল্লাহ ভীতি অর্জন করা। যাতে মানুষ এটা উপলব্ধি করে যে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের কারণে এ বিশাল পশু গুলো মানুষের অনুগত হয়েছে। মূলত কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহ মানুষের মনে আল্লাহভীতি দেখেন।আল্লাহ তায়ালা বলেন-
অর্থঃ “কুরবানির পশুর গোশত বা রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছেনা। বরং তার নিকট পৌঁছে কেবলমাত্র তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ্জ ৩৭)
কুরবানীর ইতিহাস
আদম (আঃ) -এর পুত্র ক্বাবীল ও হাবীল -এর দেওয়া কুরবানী থেকেই কুরবানীর ইতিহাসের শুরু হয়েছে। তবে আমাদের উপর যে কুরবানীর নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলতঃ ইবরাহীম (আঃ) কর্তৃক পুত্র ইসমাঈল (আঃ) -কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেওয়ার অনুসরণে পশু কুরবানীর হুকুম দেওয়া হয়েছে। এই কুরবানীর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-
অর্থঃ “যখন সে(ইসমাঈল) তার পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন তিনি (ইবরাহীম) তাকে বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবহ করছি। অতএব বল, তোমার মতামত কি? ছেলে বলল, হে আব্বা! আপনাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা প্রতিপালন করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। অতঃপর যখন পিতা ও পুত্র আত্মসমর্পন করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে ফেলল, তখন আমি তাকে ডাক দিলাম, হে ইবরাহীম! নিশ্চয়ই তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। আমি এমনিভাবে সৎকর্মশীল বান্দাদের পুরষ্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তার (ছেলের) পরিবর্তে (আমার নিজের পক্ষ থেকে) একটা বড় কুরবানী (-র জন্তু সেখানে) দান করলাম। (অনাগত মানুষদের জন্য এ বিধান চালু রেখে) তার স্মরণ আমি অব্যাহত রাখলাম। ইবরাহীমের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক।” (সূরা ছফফাত ১০২-১০৯) kurbanir etihas
কোন কোন পশু দিয়ে কুরবানী জায়েয
কুরবানীর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে পশু ক্রয় করা। কুরবানির পশু সুঠাম, সুন্দর ও নিখুঁত হওয়া চাই। তাই পশু কেনার ক্ষেত্রে অবশ্যই যাচাই বাছাই করে ক্রয় করতে হবে। kurbanir poshu
১. উট
২. গরু
৩. মহিষ
৪. ছাগল
৫. ভেড়া এবং
৬. দুম্বা
এ ছয় প্রকারের পশু ব্যতীত অন্যকোন পশু দিয়ে কুরবানী করলে তা জায়েয হবে না।
কুরবানীর পশুর বয়স কত হতে হবে
১. ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা- ১ বছর।
২. গরু ও মহিষ – ২ বছর।
৩. উট – ৫ বছর।
কমপক্ষে এই বয়স পূর্ণ হতে হবে। ভেড়া ও দুম্বা যদি দেখতে ১ বছরের মত মনে হয় তবে তা দিয়ে কুরবানী দেওয়া যাবে। রাসুল ( সঃ ) বলেছেন- “নির্দিষ্ট বয়স পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো পশু তোমরা কুরবানী করো না। তবে তা পেতে যদি কখনো দুষ্কর হয়ে যায়, তাহলে শুধু সেক্ষেত্র ছয়মাস বয়সের মেষ-শাবক কুরবানী করতে পার।” (মুসলিম ১৯৬৩) kurbanir poshur byos
পশুর কি দোষ থাকলে কুরবানী জায়েয হবে না
১. সুস্পষ্ট কানা
২. সুস্পষ্ট রোগা বা অসুস্থ
৩. সুস্পষ্ট খোঁড়া।
৪. অতি বেশি শুকনা, পাতলা বা হাড্ডিসার।
৫. চোখ আছে কিন্তু অন্ধ।
৬. পেটে বাচ্চা আছে এবং কিছু দিনের মধ্যেই বাচ্চা প্রসব করবে এমন।
৭. শিং বা কান কাটা।
শরীকে কুরবানী দেওয়া
হযরত জাবের (রাঃ) বলেন- “আমরা আল্লাহর রাসুলের (সঃ) সাথে হজ্জ ও ওমরাহ্র সময় সাথী ছিলাম। তখন আমরা একটি গরু ও উটে সাত জন করে শরীক হয়েছিলাম।”(মুসলিম)
অন্য এক হাদিসে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন- “আমরা রাসুলের (সঃ) সাথে এক সফরে ছিলাম। এমতাবস্থায় কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হল। তখন আমরা সাত জনে একটি গরু ও দশ জনে একটি উটে শরীক হলাম।”(তিরমিযী)
শরীকে কুরবানী করলে যে বিষয় খেয়াল রাখতে হবে-
১. উট, গরু, মহিষকে সর্বোচ্চ ৭ শরীকে কুরবানী দেওয়া যাবে। তবে কোন কোন বর্ণনা মতে উটকে সর্বোচ্চ ১০ শরীক পর্যন্ত দেওয়া যাবে। অন্যদিকে ছাগল, ভেড়া, দুম্বা যত বড়ই হোক না কেন তা শরীকে দেওয়া যাবে না।
২. শরীকে কুরবানী দিলে গোশত বন্টন অবশ্যই সমান হতে হবে। এক্ষেত্রে অনুমান বা আন্দাজ না করে ওজন করে দেওয়াই যুক্তিযুক্ত।
৩. শরীকদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্তক হতে হবে। যেন সকলের নিয়ত বিশুদ্ধ হয় এবং সকলের হালাল টাকা হয়। কেননা শুধু গোশত ভক্ষণের নিয়ত বা হারাম টাকা হলে কুরবানী হবে না।
কুরবানীর গোশত বণ্টন
কুরবানীর গোশতকে ৩ ভাগে ভাগ করতে হয়-
১. নিজের জন্য
২. আত্ময় স্বজনের জন্য
৩. গরিব-দুঃখীদের জন্য
কেউ যদি চায় সবটুকু বিলিয়ে দিতে অথবা নিজের জন্য রেখে দিতে তাও পারবে। তবে সবটুকু নিজের জন্য রাখা উচিত নয়। আল্লাহ সকলের কুরবানীকে কবুল করুন।
কুরবানী সবসময় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করতে হবে। কোনোভাবেই লোক দেখানো বা শুধুমাত্র মাংস খাওয়ার জন্য কুরবানি করা যাবে না। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক নিয়ম মেনে বিশুদ্ধ নিয়তে কুরবানি করার তৌফিক দান করুন।