ডায়াবেটিস মেলিটাস বা বহুমূত্র রোগ- মানবদেহের হরমোন জনিত একটি রোগের নাম। রক্তে শর্করার অসামঞ্জস্যতার কারনে এ রোগটি হয়ে থাকে। অগ্ন্যাশয়ে উৎপাদিত ইনসুলিন নামক হরমোনের ঘাটতি এ রোগের মূল কারণ। এ হরমোনটি দেহকোষগুলোকে রক্ত থেকে শর্করা বা গ্লুকোজ সংগ্রহে সহায়তা করে। কিন্তু যদি অগ্ন্যাশয়ে ইনসুলিন উৎপাদন না হয় বা উৎপাদিত ইনসুলিন দেহকোষ ব্যবহার করতে না পারে তখন রক্তে গ্লুকোজের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। এর ফলে দেহে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। রক্তে শর্করা বা গ্লুকোজের এ অসামঞ্জস্যতা থেকে যে রোগের উৎপত্তি হয় তাকেই ডায়াবেটিস নামে অভিহিত করা হয়।
মূলত তিন ধরনের ডায়াবেটিসের কথা বেশি শোনা যায়। যথা-
টাইপ-১ ডায়াবেটিস মেলিটাস বা ইনসুলিন নির্ভর ডায়াবেটিস। এটি বেশিরভাগ শিশু বা তরূণদের হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে দেহযন্ত্রের অগ্ন্যাশয়ে কোন ইনসুলিন উৎপাদন হয়না। ফলে এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে ইনসুলিন ইনজেকশন বা ইনসুলিন পাম্প ব্যবহার করতেই হয়।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস মেলিটাস বা ইনসুলিন নিরপেক্ষ ডায়াবেটিস। এ ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের দেহে ইনসুলিন উৎপাদিত হয়, কিন্তু দেহ সে ইনসুলিন ব্যবহারে সক্ষম হয়না বা অনেক সময় উৎপাদিত ইনসুলিন দেহের জন্য পর্যাপ্ত হয়না। ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ এ ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
আরও এক ধরনের ডায়াবেটিস আছে যেটি নারীদের গর্ভাবস্থায় দেখা দেয়। একে জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বলে।
এক সময় ডায়াবেটিসকে সম্পূর্ণরূপে অপ্রতিরোধ্য রোগ বলে মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমানে উন্নত গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি যে টাইপ-২ ধরনের ডায়াবেটিস যেমনি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তেমনিভাবে জীবন ব্যবস্থাপনায় যথাযথ পরিবর্তন আনার মাধ্যমে এটি প্রতিরোধও করা যায়।
বেশ কিছু বিষয় আছে যেগুলো টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে দায়ী। যেমন-
- অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস;
- কায়িক পরিশ্রমহীনতা;
- এমন কোন অসুস্থতা যেটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয় বা অগ্ন্যাশয়ে ইনসুলিন উৎপাদক কোষকে নষ্ট করে দেয়;
- স্থূলতা বা মেদজনিত সমস্যা;
- স্টেরয়েড সমৃদ্ধ ঔষধ গ্রহণ;
- দুঃশ্চিন্তা বা অতিরিক্ত পরিমাণে শর্করা জাতীয় খাদ্যগ্রহণ ইত্যাদি।
অর্থাৎ, বোঝা যাচ্ছে যে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি আসলে আমাদের হাতেই আছে। এর জন্য সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে জীবনাচরণে যথাযথ পরিবর্তন আনার মানসিক প্রস্তুতি ও সে অনুযায়ী কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ।
প্রথমেই আপনাকে ফলপ্রসূ পরিবর্তনের জন্য মনকে তৈরি করতে হবে এবং কোন কোন বিষয়ে আসলে পরিবর্তনগুলো আনা প্রয়োজন তার একটি তালিকাও করে ফেলতে হবে। যেমন-
- আপনার কি ওজন কমাতে হবে কিনা, হলে কতটুকু?
- আপনি কেমন খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত? আপনার খাদ্যতালিকায় সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে কিনা?
- আপনি পরিমিত পরিমাণে শর্করা গ্রহণ করছেন কিনা?
- আপনি সপ্তাহে অন্তত চারদিন ৩০ মিনিট করে ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করছেন কিনা?
- আপনার ধূমপানের অভ্যাস আছে কিনা?
- আপনি নিয়মিত ডাক্তার দেখাচ্ছেন কিনা?
- নিয়মিত ব্লাড শ্যুগার পরীক্ষা করা হচ্ছে কিনা এবং ডাক্তারের পরামর্শমত চলা হচ্ছে কিনা?
যদি এ বিষয়গুলো সঠিকভাবে পালনে কোন ঘাটতি থাকে, তাহলে সমস্যা সমাধানের জন্য আপনাকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
পরিবর্তনের জন্য নিজেকে তৈরি করুন
যে কোন পরিবর্তনই রাতারাতি করে ফেলা সম্ভব নয়। পরিবর্তনগুলো করার জন্য যে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হয়, তার জন্যও কিছু পরিকল্পনা প্রয়োজন।
প্রথমত, আপনাকে জানতে হবে যে আপনার জীবনাচরণে কিছু পরিবর্তন আনা আবশ্যক। যদি আপনি না-ই জানেন যে আপনার জীবনে কিছু পরিবর্তন আনা দরকার তাহলে আপনি এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন না।
দ্বিতীয়ত, আপনি জানেন যে, আপনার আচরণে কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন কিন্তু আপনি এ ব্যাপারে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ বা ঝুঁকি গ্রহণ করতে উৎসাহী নন, তাহলে এটি পরস্পরবিরোধী অবস্থান হবে। এ ব্যাপারে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে।
তৃতীয়ত, আপনি জানলেন এবং মানলেন যে আপনাকে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। এবারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পালা। যে কোন পরিবর্তন আনার জন্য প্রথম প্রয়োজন উপযুক্ত পরিকল্পনা করে নেয়া এবং সে অনুযায়ী ধীরে ধীরে কাজ করতে শুরু করা।
চতুর্থত, পরিকল্পনা অনুযায়ী একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যেতে হবে এবং প্রতিনিয়ত পর্যালোচনা করতে থাকতে হবে যে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজগুলো সঠিকভাবে করা হচ্ছে কিনা।
সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে সে অনুযায়ী কাজ করতে থাকলে সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনগুলো চোখে পড়তে থাকবে এবং উপকারিতাও অনুভূত হতে থাকবে।
সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করুন
আপনি যখন জীবনাচরণে পরিবর্তন আনতে প্রস্তুত এবং একটি পরিকল্পনা তৈরি করছেন তখন একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরে পরিকল্পনাটি করুন। সুনির্ধারিত পরিকল্পনা আপনাকে সহজে সফল হতে সাহায্য করবে। যেমন-
- আপনি ঠিক করে নিন যে প্রথম দিকে সপ্তাহে অন্তত তিন থেকে চারদিন দুপুরে খাবার পর ১০ মিনিট করে হাঁটবেন এবং আস্তে আস্তে এ সময় বাড়াবেন।
- যখন যতটুকু হাঁটছেন এবং যত সময় হাঁটছেন তা নোট করে রাখুন, এতে কাজের উন্নতি পর্যালোচনা করা সহজ হয়।
- পরিকল্পনাটি তৈরি করার সময় এমনভাবে করুন যাতে এটি বাস্তবসম্মত হয় এবং আপনার লাইফস্টাইল ও পারিপার্শ্বিকতার সাথে সামঞ্জস্যতাপূর্ন হয়। হয়তো এমন হতে পারে যে এতদিন আপনি দুপুরে লম্বা সময় ঘুমিয়ে অভ্যস্ত, অথচ এখন পরিকল্পনা করলেন যে দুপুরে একদমই ঘুমাবেন না এবং প্রতিদিন এক ঘন্টা করে হাঁটবেন। এটা সত্যিই কঠিন পরিকল্পনা হবে এবং হতে পারে এভাবে হঠাৎ করে নিজেকে একটা নিয়মের মধ্যে ফেলে দিলে আপনি অল্প দিনেই হাঁপিয়ে উঠতে পারেন। ফলে কাজের উৎসাহ হারিয়ে যেতে পারে। তাই নিজের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নের সময়ই খেয়াল রাখবেন, সেটি যেনো বাস্তবসম্মত ও পালনোপযোগী হয়।
- ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারন করুন এবং সেসব লক্ষ্য অর্জনে নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে নিন। যেমন প্রথমে আপনি সপ্তাহে তিন বা চারদিন দুপুরে ১৫-২০ মিনিট করে হাঁটার পরিকল্পনা করলেন। এক মাস সময় নিন এতে অভ্যস্ত হতে। হাঁটার অভ্যাসে যখন আপনি অভ্যস্ত হয়ে যাবেন তখন ধীরে ধীরে দিনের সংখ্যা ও হাঁটার সময় বাড়ান।
এভাবে ধীরস্থিরভাবে পরিকল্পনা মাফিক আগালে একসময় আপনি নিজেকে একটি নিয়মানুবর্তী, সুস্থ, ডায়াবেটিসের শঙ্কামুক্ত জীবনে আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন ইনশা আল্লাহ।
পড়ে নিন পরের পর্বটিঃ প্রাকৃতিকভাবেই নিয়ন্ত্রণ করুন ডায়াবেটিস; জেনে নিন কিছু কার্যকরী উপায় (পর্ব-২)