আপনি কি জানেন যে শুধুমাত্র জীবনাচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নামক রোগটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? স্বভাবগতভাবেই আমরা কিছুটা অপরিকল্পিত ও অনিয়মিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এটি যে শুধু ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী তা কিন্তু নয়। অপরিকল্পিত, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই মূলত আমাদের দেহে বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টির মূল কারণ।
পড়ে নিন আগের পর্বটিঃ প্রাকৃতিকভাবেই নিয়ন্ত্রণ করুন ডায়াবেটিস; জেনে নিন কিছু কার্যকরী উপায় (পর্ব-১)
আসুন দেখে নেয়া যাক জীবনাচরণে কি ধরনের পরিবর্তন আনার মাধ্যমে আমরা ডায়াবেটিসসহ আমাদের দেহের বিভিন্ন অযাচিত রোগ থেকে বেঁচে থাকতে পারি।
আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে, যে কোন পরিবর্তন আনতে হলে আপনাকে প্রথমে একটি বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং ছোট ছোট লক্ষ্য ধরে আগাতে হবে। এক্ষেত্রে আপনাকে আপনার খাদ্যাভাস ও শারীরিক পরিশ্রমের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। আপনাকে হিসেব রাখতে হবে দিনে কতটুকু ক্যালরি গ্রহণ করছেন এবং কতটুকু খরচ করছেন। আসলে জীবনাচরণে পরিবর্তন আনাটা আপনার কাছে প্রথমে চ্যালেঞ্জিং-ই হয়ে উঠতে পারে কিন্তু অন্যদিকে বলা যায়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য বা নিজের শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এটাই একমাত্র নিশ্চিত ও সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো আপনার অভ্যন্তরের সেই বিশ্বাসকে জাগিয়ে তোলা যেটি আপনাকে সাস্থ্যসম্মত, নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করবে এবং যে ধরনের জীবনযাপনে আপনি অভ্যস্ত ছিলেন সেখান থেকে বের হয়ে পরিবর্তিত নতুন জীবনযাপনে আপনাকে সাহায্য করবে। নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা, কার্যাবলীর রেকর্ড রাখা, কাজের উন্নতি পর্যালোচনা করা ইত্যাদি করতে আপনার ইচ্ছাশক্তি ও বিশ্বাসই আপনাকে সবচেয়ে বড় সাহায্যটুকু করবে।
আপনি যদি জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন, তাহলে নিচের টিপসগুলো অনুসরণ করতে পারেন।
ইতিবাচক মনোবৃত্তি তৈরি করুন
এ প্রক্রিয়ার প্রত্যেকটা কাজই আপনার কাছে প্রথম প্রথম কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা জানি, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। এই পরিবর্তনের সমস্ত দায়-দায়িত্ব নিজের উপর নেয়ার দৃঢ় মনোবৃত্তি তৈরি করে যদি কাজে নেমে যেতে পারেন তাহলে এর ফলাফল আপনি অবশ্যই পাবেন।
এ জন্য আপনাকে যা করতে হবে-
- ‘আমার সময় নেই’, ‘আমার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ঠিক নেই’, ‘আমি ব্যায়াম করার জন্য সময় বের করতে পারছিনা’ নিজের কাছে নিজে এসব অজুহাত দেখানো বন্ধ করুন। পরিকল্পনাটাই তৈরি করুন এমনভাবে, যাতে নিজেকে এসব অজুহাত দেখানোর সুযোগই না পাওয়া যায়।
- ‘আমি চাই, কিন্তু আমার ইচ্ছাশক্তি এত দৃঢ় নয়’ আপনার ইচ্ছাশক্তিই যদি দৃঢ় না হয় তাহলে কোন বিষয়েই আপনি নিজেকে সাহায্য করতে পারবেন না, এমনকি অন্য কেউও আপনাকে সাহায্য করতে পারবে না।
ইচ্ছাশক্তি কোন জন্মগত বিষয় নয় যে কারও থাকে, কারও থাকেনা। এটি আপনাকে তৈরি করে নিতে হবে নিজের ভালোর জন্য। আপনার ইচ্ছাশক্তিই আপনাকে ভুল খাদ্যাভ্যাস, ভুল জীবনব্যবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে সবচেয়ে দ্রুত।
- ‘আর যাই হোক, আমার ওজন কোনভাবেই কমানো সম্ভব না’ বাদ দিতে চেষ্টা করুন এ ধরনের সমস্ত নেতিবাচক চিন্তা কারণ এগুলো আপনাকে কাজ শুরু করার আগেই মানসিকভাবে পিছিয়ে ফেলে এভাবে যে আপনার পক্ষে এ কাজ করা কখনও সম্ভব না।
অতএব, নেতিবাচক চিন্তা করা বাদ দিয়ে ইতিবাচকভাবে ভাবতে শুরু করুন এবং দৃষ্টিপাত করুন সেসব কাজে যেগুলো আপনাকে লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
নিজের দায়িত্ব নিজেই নিন
সঠিক খাদ্যাভ্যাস রপ্ত করা, ওজন কমানো, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়ামে অভ্যস্ত হয়ে উঠা- এসব শুরুর দিকে অনেকের কাছেই বেশ কঠিন হয়ে উঠে। এগুলোতে অভ্যস্ত হতে আপনি যা যা করতে পারেন-
- আমরা অনেকেই আছি যখন যা চোখের সামনে আসে তাই খেয়ে ফেলি যদি সেটি আমাদের সাস্থ্যের জন্য ভালো নাও হয়। ভাজা-পোড়া, ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার দেখলে আমরা নিজেদেরকে সংবরণ করতে পারিনা। মাঝে মাঝে খেলে ভিন্ন কথা, কিন্তু এসব খাবারের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ বা এ ধরনের খাবার অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া কারও জন্যই স্বাস্থ্যকর নয়। আর যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের তো অবশ্যই ভাজা-পোড়া খাবার, ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাবার, মিষ্টান্ন যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত।
ভালো হয়, একজন ডায়েটিশিয়ানকে দিয়ে একটি খাদ্যতালিকা তৈরি করিয়ে নিলে। যখনই অস্বাস্থ্যকর কোন খাবার সামনে আসবে, চেষ্টা করবেন নিজেদের বিরত রাখতে। এজন্য প্রথম প্রথম এ রকম পরিস্থিতিতে পড়লে মনে মনে ২০ পর্যন্ত গুণতে থাকবেন। এটা ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার এক প্রকার ব্যায়াম। একবারেই আপনি সফল হবেন এমনটা ভাবা ঠিক হবেনা। যে কোন অভ্যাস রপ্ত করতে নিজেকে সময় দিন। নিজেকে দেয়া প্রতিজ্ঞা বার বার নিজেকে মনে করিয়ে দিন। একসময় দেখবেন আপনি যা চাচ্ছেন তা ধীরে ধীরে করতে সক্ষম হবেন।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের সময় আরেকটি কাজ করতে পারেন, সেটি হলো আপনার জন্য ক্ষতিকর এমন খাবারগুলো থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করুন। বাসায় সে রকম খাবার বানানো বা রাখা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করতে পারেন।
- ডায়াবেটিসের জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে আপনি আরও একটি বড় সাফল্য অর্জন করতে পারেন। তা হলো সঠিক ওজন লাভ। অনেক ডায়াবেটিস রোগী স্থূলতা সমস্যাতেও ভুগে থাকেন। এ অভ্যাস তাদের জন্য বাড়তি সাফল্য বয়ে আনবে।
- নিজে নিজে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে গেলে হতে পারে আপনি কখনও কখনও মনোবল হারিয়ে ফেলতে পারেন। তাই চেষ্টা করুন আপনার পরিবারের সদস্যদের বা কাছের মানুষদের সাহায্য নিতে। যারা আপনার মনোবল অটুট রাখতে এবং প্রয়োজনীয় সাহায্যগুলো করতে আপনার পাশে থাকতে পারবে।
- ব্যায়াম করতে ভুলে যাবেন না। আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় এখন বলতে গেলে আমরা কায়িক পরিশ্রমহীন অলস জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু কায়িক পরিশ্রমহীনতা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
তাই প্রতিদিন অথবা সপ্তাহে কমপক্ষে চারদিন ৩০ মিনিট করে হাঁটার অভ্যাস তৈরি করা উচিত। সেই সাথে ঘরেই কিছু ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করে নিলে সেটা আরও ভালো। হাঁটার সময়টা ধীরে ধীরে বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
অনেকে শুধুমাত্র খাবার বন্ধ করে দিয়ে বা ওষুধ খেয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এসবে পুরোপুরি সফল হওয়া সম্ভব নয়। এ রোগটি আপনার জীবন-যাপনের পদ্ধতির সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। তাই এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে বা প্রতিরোধ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই 3D নিয়মটি মেনে চলতে হবে। ডাক্তারদের অভিধানে ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসার জন্য এই তত্ত্বটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 3D বলতে বুঝায়- Discipline (নিয়মানুবর্তিতা), Diet (খাদ্যাভ্যাস), Drug (ঔষধ)। অর্থাৎ, বুঝতেই পারছেন এই 3D- এর সমন্বয় ঘটাতে পারলেই ডায়াবেটিস নামক রোগটি, যা পৃথিবীব্যাপী মহামারী হিসেবে ঘোষিত হয়েছে, শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রণ নয় প্রতিরোধ করাও সম্ভব। আর প্রতিরোধের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্রথম দুটি ‘D’- অনুসরণ করাই যথেষ্ট। এজন্য দরকার শুধু সচেতনতা, সঠিক জ্ঞান ও সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি।