ইসলামে তালাক খুবই নিকৃষ্ট কাজ। শুরুতেই কোনো ছোট খাটো কারণে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া যাবে না। কেননা ডিভোর্স সব সমস্যার সমাধান নাও হতে পারে। এজন্য কিছু ধাপ অনুসরণ করতে হবে। Islamic talaq rules অনুযায়ী, তালাক দেওয়ার আগে প্রথমে স্ত্রীকে বুঝাতে হবে, তাতে কাজ না হলে তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতে হবে, আলাদা বিছানায় ঘুমানো যেতে পারে, প্রয়োজনে মৃদু প্রহার(ব্যাথা যেন না পায় এমনভাবে) করা যেতে পারে। সবচেয়ে যেটা কার্যকর তাহলো স্ত্রীর নাম ধরে আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
কখন তালাক দেওয়া যাবে
মাসিকের সময় এবং গর্ভ অবস্থায় তালাক দেওয়া অনুচিত। তালাক দিতে হবে যখন স্ত্রী পবিত্র অবস্থায় থাকে। সীমা অতিক্রম করলেই কেবল তালাক দেওয়া যাবে। স্ত্রী যদি আল্লাহর অবাধ্য হয়, পর্দা না করে, অশ্লীল কাজে যুক্ত হয়ে যায় ইত্যাদি গুরুতর বিষয়ে স্ত্রীর সাথে মনমালিন্য হলে নিজেরা মিমাংসা করার চেষ্টা করবেন। না পারলে উভয় পক্ষের অভিভাবকের সাহায্য নিবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- অর্থঃ “আর তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশংকা করলে তোমরা স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত কর; তারা উভয়ে নিস্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত।”( সূরা নিসা ৩৫)
তাতেও সমস্যার সমাধান না হলে ১ তালাক দিবেন এবং এক ইদ্দত(৩ মাস) সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। এই সময়ের মধ্যে যদি সে তার ভুল বুঝতে পারে তাহলে তাকে নিয়ে সংসার করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু যদি এই সময়ের মধ্যে তারা যদি ফিরে না আসে তাহলে তালাক কার্যকর হয়ে যাবে। এক তালাক কার্যকর হওয়ার পর পুনরায় সংসার করতে হলে আবার বিয়ে করতে হবে।
وَ اِذَا طَلَّقۡتُمُ النِّسَآءَ فَبَلَغۡنَ اَجَلَہُنَّ فَلَا تَعۡضُلُوۡہُنَّ اَنۡ یَّنۡکِحۡنَ اَزۡوَاجَہُنَّ اِذَا تَرَاضَوۡا بَیۡنَہُمۡ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ؕ ذٰلِکَ یُوۡعَظُ بِہٖ مَنۡ کَانَ مِنۡکُمۡ یُؤۡمِنُ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ ذٰلِکُمۡ اَزۡکٰی لَکُمۡ وَ اَطۡہَرُ ؕ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ وَ اَنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ(সূরা বাক্বরা ২৩২)
অর্থঃ”আর তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দাও( ১ম ও ২য় বার) এবং তারা তাদের ‘ইদ্দতকাল পূর্ণ করে, এরপর তারা যদি বিধিমত পরম্পর সম্মত হয় , তবে স্ত্রীরা নিজেদের স্বামীদের বিয়ে করতে চাইলে তোমরা তাদেরকে বাধা দিও না। এ দ্বারা তাকে উপদেশ দেয়া হয় তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ্ ও আখেরাতে ঈমান রাখে, এটাই তোমাদের জন্য শুদ্ধতম ও পবিত্রতম। আর আল্লাহ্ জানেন এবং তোমরা জান না।”
যদি ভবিষ্যৎতে ২ তালাক দিয়ে থাকেন তবে একই ভাবে এক ইদ্দত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে যদি এর মধ্যে দুইজনের মিল হয়ে যায় তাহলে সংসার করতে কোনো সমস্যা থাকবে না। কিন্তু যদি ৯০ দিন অতিবাহিত হয়ে যায় তাহলে তালাক কার্যকর হয়ে যাবে। এরপর যদি নিজেদের ভুল বুঝে সংসার করতে চায় তাহলে পুনরায় বিয়ে করতে হবে।
এরপর মনে রাখতে হবে ৩ তালাক( 3 times divorce) দিলে স্ত্রীকে বিয়ে করার কোনো সুযোগ নেই। তার মানে ৩ তালাক কখনোই দেওয়া উচিত নয়। আর যদি দেন তার মানে আপনি আর এই স্ত্রী চান না। তখন আর সংসার করার কোনো সুযোগ থাকে না। তবে একটা সুযোগ থাকে যা কল্পনাতীত সেটা হলো হিল্লা বিয়ে।
ইসলামে হিল্লা বিয়ে
فَاِنۡ طَلَّقَہَا فَلَا تَحِلُّ لَہٗ مِنۡۢ بَعۡدُ حَتّٰی تَنۡکِحَ زَوۡجًا غَیۡرَہٗ ؕ فَاِنۡ طَلَّقَہَا فَلَا جُنَاحَ عَلَیۡہِمَاۤ اَنۡ یَّتَرَاجَعَاۤ اِنۡ ظَنَّاۤ اَنۡ یُّقِیۡمَا حُدُوۡدَ اللّٰہِ ؕ وَ تِلۡکَ حُدُوۡدُ اللّٰہِ یُبَیِّنُہَا لِقَوۡمٍ یَّعۡلَمُوۡنَ(সূরা বাক্বরা ২৩০)
অর্থঃ “অতঃপর যদি সে স্ত্রীকে তালাক দেয়(তৃতীয় বার) তবে সে স্ত্রী তার জন্য হালাল হবে না, যে পর্যন্ত সে অন্য স্বামীর সাথে সংগত না হবে। অতঃপর সে (দ্বিতীয় স্বামী) যদি তালাক দেয় আর তারা উভয়ে (স্ত্রী ও প্রথম স্বামী) মনে করে যে, তারা আল্লাহ্র সীমারেখা রক্ষা করতে পারবে, তবে তাদের পুনর্মিলনে কারো কোন অপরাধ হবে না। এগুলো আল্লাহ্র সীমারেখা, যা তিনি স্পষ্টভাবে এমন কওমের জন্য বর্ণনা করেন, যারা জানে।”
যদি ৩ তালাক কার্যকর হয় তখন স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহের সুযোগ থাকে না। তবে যদি তালাক প্রাপ্ত মহিলাকে কোন ব্যাক্তি সেচ্চায় বিয়ে করে এবং বিবাহের পর কোনো এক সময় এই ব্যাক্তি মারা যায় অথবা কোন কারণে স্ত্রীকে তালাক দেয় তাহলে এই মহিলা তার পূর্বের ১ম স্বামীকে পুনরায় বিবাহ করতে পারবে। যা কল্পনাতীত বা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
বানোয়াট হিল্লা বিয়ে কি?
৩ তালাক প্রাপ্ত স্ত্রীকে স্বামীর কাছে হালাল করার জন্য কোনো ব্যাক্তির সাথে এইরূপ চুক্তি করা যে, তুমি আমার স্ত্রীকে বিয়ে করে একদিন পর তালাক দিয়ে দিবে। এরপর তাকে আমি বিয়ে করতে পারবো। এইরূপ হিল্লা বিয়ে সম্পূর্ণ হারাম।
একসাথে তিন তালাক
একসাথে তিন তালাক ( 3 talaq at a time) দেওয়ার নিয়ম নেই। একই সাথে তিন তালাক দেওয়া হারাম। এখন প্রশ্ন হলো, একই সাথে তিন তালাক দিলে কি তালাক হবে? এখানে দুইটি মত পাওয়া যায়- প্রথমটি হলো, একই সাথে তিন তালাক দিলে তা তিন তালাক হিসাবেই গণ্য হবে। ফলে স্ত্রীর সাথে সংসার করার আর কোনো সুযোগ নেই। কল্পনাতীত একটা সুযোগ থাকে যা হলো হিল্লা বিয়ে। এই মতটির সাথে ৪ মাহযাবের ঈমামরা একমত হয়েছেন। যার ফলে উম্মতের অধিকাংশ লোক এই মত গ্রহণ করেছে।
দ্বিতীয় মতটি হলো, একসাথে তিন তালাক দিলে তা এক তালাক হিসাবে গণ্য হবে। এতে করে ইদ্দতের মধ্যে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। এছাড়া ইদ্দতের মধ্যে ফিরিয়ে না নিলেও পুনরায় বিয়ে করার সুযোগ থাকে। এই মতটি কুরআন সুন্নাহের অনুযায়ী বিশুদ্ধ বলে বিবেচিত হয়। আমাদের বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেও দ্বিতীয় মতটি গ্রহণ করেছে। এছাড়া সৌদিআরব, ভারত, পাকিস্তান, মিশর, আফগানিস্তান, মালেয়েশিয়া, ইরাক, মরোক্ক, ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়া, আলজেরিয়া, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ইত্যাদি দেশের আইনেও দ্বিতীয় মতটি গ্রহণ করেছে।
দুইটি মতের মূল কারণ হলো, রাসুল (সাঃ) এর সময় ও আবু বকর (রাঃ) এর শাসন আমলে এবং ওমর (রাঃ) শাসনের প্রথম দুই বছর পর্যন্ত একসাথে তিন তালাক( 3 talaq in islam) দেওয়া নিষিদ্ধ ছিলো এবং দিলোও তা এক তালাক হিসাবে গণ্য হতো। কিন্তু ওমর (রাঃ) শাসনামলের সময় তিনি দেখলেন যে, মানুষের মধ্যে একসাথে তিন তালাক দিয়ে আবার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে তাই তিনি রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করলেন যে, একসাথে তিন তালাক দিলে তা তিন-ই তালাক হয়ে যাবে। এই আইন জারির মূল উদ্দেশ্য ছিলো একসাথে তিন তালাক দেওয়ার প্রবণতা কমিয়ে আনা। তখন থেকেই এই মতটি প্রাধান্য পায়।
সুতরাং কখনোই একইসাথে তিন তালাক(triple talaq) দেওয়া উচিত নয়। কেননা ইহা কুরআন, হাদীসের পরিপন্থী। এতে ফিরে আসার সুযোগ থাকে না। আর যদি কেউ দিয়েই ফেলে তাহলে তার সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী যেকোনো একটি মত গ্রহণ করা যাবে।
কি অবস্থায় তালাক হবে না
পাগল, মাতাল অবস্থায় স্ত্রী তালাক দিলে তাতে তালাক হবে না। কারো ছাপে বা যবরদস্তিতে পড়ে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধ তালাক দিলেও তা হবে না। এছাড়াও অধিক রাগান্বিত অবস্থায় যদি স্বাভাবিক চেতনা হারিয়ে ফেলে তাহলে তালাক দিলে তা কার্যকর হবে না।
মাসিক অবস্থায় তালাক দেওয়া বৈধ নয়। তবে কোনো কোনো মতে দিলে তা হয়ে যাবে। নিয়ম হলো মাসিক থেকে পবিত্র হলে সহবাস না করেই তালাক দিতে হবে। গর্ভবতী স্ত্রীকে তালাক দিলে তার ইদ্দত হবে সন্তান প্রস্রাব করা পর্যন্ত। তালাক দেওয়ার সময় অবশ্যই সুন্নত মোতাবেক দিতে হবে। এজন্যে এক তালাক দিয়ে ইদ্দত গণনা করতে হবে। কেননা এতে চিন্তা ভাবনা করে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে বা পুনরায় বিয়েরও সুযোগ থাকে।